Magic Lanthon

               

উৎকলিকা দাস দিশা দেবাশীষ কে. রায় ও আসাদ লাবল

প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ঋতুপর্ণের চোখের বালি : বিনির্মাণের ধোয়ায় প্রাচ্যে-নারীর ধবধবে পিঠ

উৎকলিকা দাস দিশা দেবাশীষ কে. রায় ও আসাদ লাবল


সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বলেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সের্গেই আইজেনস্টাইন। চিত্রপরিচালক সাহিত্য থেকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেন, আংশিক নিতে পারেন, আরেকটি হলো পয়সার জন্য করে যাওয়া। তবে এর বাইরে গিয়েও আরও একটি পদ্ধতি এক্ষেত্রে ব্যবহার করতে দেখা যায়; সেটি বিনির্মাণ। অর্থাৎ, কাহিনীর ভাব সম্পূর্ণ গ্রহণ করার পাশাপাশি কাহিনীর বক্তব্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। বাংলা চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক বিনির্মাণের একটি বড় উদাহরণ। ঋত্বিক এখানে সুবোধ ঘোষের কাহিনী ও ভাব সম্পূর্ণ গ্রহণ করেছেন এবং বাড়তি কিছু যোগ করে সুবোধ ঘোষের বক্তব্যকে ছাড়িয়ে গেছেন। অনুরূপভাবে, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে ঋতুপর্ণ ঘোষ তার চোখের বালি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে যেটি করেছেন বা করতে চেয়েছেন সেটিকেও আপাতভাবে বির্নিমাণ বলা যেতে পারে। তবে সেই বিনির্মাণের যথার্থতা নিয়ে সাধারণ দর্শক হিসেবে আমাদের ভিতরে কিছু খট্কা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি সংশয় তৈরি হয়েছে উপন্যাস আর চলচ্চিত্রে বিনোদিনীকে উপস্থাপনের ভিন্নতা দেখে। চোখের বালি দেখতে গিয়ে আমাদের বারবার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীর মধ্যে যতোটা ব্যক্তিত্বের ছাপ, ঋতুপর্ণের বিনোদিনীতে ততোটাই যৌনতার ছাপ। যৌনাবেদনময়ীতার কাছে বিনোদিনীর ব্যক্তিত্ব যেন মলিন হয়ে গেছে। তাই এই লেখার দুটি ভাগে আমরা সেই খটকা এবং সংশয়গুলো উপন্যাসের সাধারণ পাঠক এবং চলচ্চিত্রের সাধারণ দর্শক হিসেবে বলার চেষ্টা করেছি।

১.
রবীন্দ্রনাথের চোখের বালির শেষাংশ; পাঠক, সমালোচক- এমনকি খোদ রবীন্দ্রনাথের নিজের মধ্যেই নাকি নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। আর পরিচালক ঋতুপর্ণের ভাষায় উপন্যাসের শেষটা নাকি হাস্যকর। তিনি এক সাক্ষাতকারে উপন্যাসের শেষটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন এভাবে, “উপন্যাসের সমাপ্তিটা বেশ হাস্যকর। হঠাৎ করেই সবাই সুখী হয়ে যায়, পরিবারটাকে খুব ভালো মনে হতে থাকে এবং তারা দুজনেই বিনোদিনীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। দুই পুরুষ মহেন্দ্র ও বিহারী বলে, ‘বৌদি, আমাদের ক্ষমা করে দাও, ভুল হয়েছে।’ সেও তাদের ক্ষমা করে দেয়। এরপর সে বেনারসে গিয়ে তপস্বীর মতো জীবনযাপন শুরু করে।”

সাক্ষাতকারটিতে ঋতুপর্ণ আরো বলেন, ‘এই উপন্যাসের এমন সমাপ্তি হতে পারে না। অনেক পাঠক চেয়েছিলেন বিনোদিনীর সাথে বিহারীর বিয়ে হোক। আমি মনে করি, আজ থেকে ৩০ বছর আগে হলে তা সম্ভব ছিল। কারণ তখন বিধবা বিয়েকে উৎসাহিত করা হচ্ছিল, এ নিয়ে প্রচার চলছিল। সবাই তখন মনে করতো, আরেকটি বিয়ে হলে বিনোদিনী আবার জীবন শুরু করতে পারবে। কিন্তু আজকের অবস্থা ভিন্ন। এখন নারীর জীবন চালানোর জন্য কোনো পুরুষের শেষ নাম, উপাধি বা কোনো ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। বিনোদিনী আগে বিয়ে করেছে এবং বিয়ে তাকে কিছুই দেয় নি, এতে তার কোনো সাহায্যও হয় নি। একা থাকাটাই তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।’

আর সেজন্যই ঋতুপর্ণ চোখের বালি চলচ্চিত্রের শেষটা একটু অন্যরকম করতে চেয়েছেন। করেছেনও। চোখের বালি সিনেমার শেষের দিকে আমরা দেখি বিহারী বিয়ে করার প্রস্তুতি নিয়ে বিনোদিনীর কাছে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখে বিনোদিনী ঘরে নেই; চলে গেছে। কোথায় গেছে, কার কাছে গেছে- কিছুই জানা যায় না। বিনোদিনী কেবল আশাকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখে গেছে। যে চিঠিতে বিনোদিনী তার সই আশাকে অনুরোধ করে লিখেছে,

‘ভাই বালি, তোর আর আমার মধ্যে বাইরে অনেক অমিল ছিল।
তবুও আমরা সই পাতিয়াছিলুম। বেশ ছিলাম দর্জিপাড়া স্টেটের
দোতলার অন্তপুরে। সেটাই ছিল আমাদের রোজকার জগত।
যদি দেশ বলতে চাস্ তাও বলতে পারিস। অমন বাইরের অমিল
নিয়ে মিলেমিশে থাকাটা এদেশে নতুন নয়। তাই আমরাও
নতুন কিছু করিনি বালি। তাই বলে অন্তরের মিল বলতে সত্যিই
কি কিছু ছিল না? ছিল। সংসার করার সাধ; ওই যে বললুম,
ওই দর্জিপাড়ার স্টেটের অন্তপুরের বাইরে আমরা আর কিচ্ছু দেখি
নি। তাই আমাদের দেখা একটা মানুষকে নিয়ে দুজনেই সেই
সাধ মেটাতে চেয়েছি। তাতে সাধও মেটেনি, আমাদের ছোট্ট
দেশটুকু ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কার্জন সাহেবের আইন
সত্যিই যদি ফলে, তবে এখন থেকে তুই আর আমি আলাদা দেশে
থাকবো। সেই দুই দেশে বসে আমরা যদি নিজে নিজে এতো
দিনকার অপমান, দুঃখ আর বঞ্চনার কথাই কেবল ভাবি, তাহলে
তো আমরা প্রথম থেকেই হার মেনে নিলুম। আসলে দেশ তো
মনের মধ্যে বালি। ...যেদিন ওই দর্জি পাড়ার স্টেট ছেড়ে
কাসী ঘাটে গিয়ে দাঁড়ালুম, সেদিন প্রথম জানলুম সত্যিকারের
দেশ কাকে বলে! সেখানে হেঁশেল, উঠোন, খরখড়ি, এঁটো
শকড়ির বাইরেও যে একটা বিরাট জগত, সে তো আমরা
বইয়ে পড়েছি রে! আর ভেবেছি গল্পকথা। মহাভারতে আছে
অভিমন্যু মায়ের পেটের মধ্যেই মস্ত বীর হয়েছিল। তোর পেটে
যে সন্তান, সে তোর সাথে সাথে রোজ গঙ্গাস্নান করেছে। দোহাই
বালি, সে ছেলেই হোক আর মেয়েই হোক, তাকে কেবল ওই
দর্জি পাড়ার স্টেটের দোতলার বাড়িতে আটকে রাখিস নে। দেখবি,
সত্যিকারের দেশ কাকে বলে, সেই একদিন তোকে বুঝিয়ে দেবে।’


বিনোদিনী এই চলে যাওয়া নিয়ে বিহারীর অনুমান, হয়তো বিনোদিনী নতুন কোনো ভারতবর্ষের সন্ধান পেয়েছে। এবং সে সেখানেই গেছে। এই সমাপ্তি নিয়ে আমাদের ভাবনাটা একটু পরে বলবো। তার আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের ভাবনাটা জানা দরকার। তিনি তার ছবির শেষের ভাবার্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওই সাক্ষাতকারে বলেন, ‘নারীর কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা কোনো নির্দিষ্ট পরিচয়ে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া উচিত নয়। পুরুষ কখনো তার পরিচয় পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু নারী পারে। একজন স্বাধীন নারীর জন্য আমি তাই একে দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করব। সিনেমার শেষে বিনোদিনী এই দেশের কথাই বলে।’

এবার আসি আমাদের ভাবনায়। উপন্যাসে বিনোদিনী কাসীতে চলে যায় অন্নপূর্ণার সাথে। আর সিনেমার বিনোদিনী কোথায় যায় তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। বিহারী বলেন, হয়তো সে নতুন কোনো ভারতবর্ষে গিয়েছে। আবার বিনোদিনীর চিঠির ভাষায় মনে হয় সেটা পূর্ব বাংলা। কিন্তু আমাদের কাছে বিনোদিনীকে কিন্তু নিরুদ্দেশই মনে হয়েছে। ঋতুপর্ণ বলছেন, উপন্যাস চোখের বালি থেকে সিনেমা চোখের বালির শেষটা ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসে মহেন্দ্র-বিহারীকে বিনোদিনীর পায়ের কাছে এনে ক্ষমা চাইয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সমাজ থেকে তাকে বের করতে পারেন নি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে পারেন নি ঋতুপর্ণও। বিনোদিনীকে তিনি নিরুদ্দেশ করেছেন, নারী থেকে মানুষ করে তুলতে পারেন নি।

কারণ নিরুদ্দেশ আর তপস্বীর মধ্যে আপাত কোনো পার্থক্য নেই। প্রথা মেনে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ হলো তপস্বী, আর সমাজ-সংসার, সময়ের কাছে হেরে অপ্রথাগতভাবে নিয়তির কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া হলো নিরুদ্দেশ। কাউকে কিছু না বলে বিনোদিনীর প্রস্থান জীবনযুদ্ধ থেকে এক ধরনের পলায়ন। আর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া মানে তো হার মেনে নেওয়া। তাই শেষ পর্যন্ত উপন্যাস ও সিনেমাতে বিনোদিনীর পরিণতি আমাদের কাছে একই মনে হয়েছে।

সিনেমায় বিনোদিনী যে দেশের কথা বলেছেন সে দেশ রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে অতিক্রম করতে পেরেছে কি না তা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। এখানে মূলত বিনোদিনী নতুন দেশ বলতে হয়তো সম্ভাবনা ও স্বপ্নের কথা বলেছেন। নিজের বর্তমান থেকে সরে দাঁড়িয়ে সে স্বপ্ন তিনি আরোপিত করেছেন আশা’র অনাগত সন্তানের ওপর। উপন্যাসে উনিশ শতকের গোড়ার দিকের বাঙালি হিন্দু শিক্ষিত মেয়েদের প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্রের নাম বিনোদিনী। যে বিনোদিনীরা নিজেদের মুক্তির স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনী শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারে নি। সেদিক দিয়ে দেখলে রবীন্দ্রনাথের ভাবার্থ দাঁড়ায়Ñ স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে বিনোদিনীদের চেষ্টা চলছিল স্বপ্ন-বাস্তবায়নের; কিন্তু তখনো তারা পেরে উঠছিলেন না; মুক্তির স্বপ্ন দেখলেও শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়েছেন সমাজ, ধর্মের কাছে। ঋতুপর্ণের বিনোদিনীও জিততে পারে নি; জয়ী হওয়ার ব্যাপারে তিনি ভবিষ্যতের স্বপ্নে নির্ভর ছিলেন। তাহলে এই বিনোদিনীর সাথে রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীর পার্থক্য কোথায়?

২.
এবার আমরা উপস্থাপনের দিক দিয়ে উপন্যাসের বিনোদিনী আর চলচ্চিত্রের বিনোদিনীকে আলাদাভাবে দেখার চেষ্টা করবো; একই সাথে ধরার চেষ্টা করবো দুই বিনোদিনীর বৈসাদৃশ্যগুলো। এক্ষেত্রে প্রথমেই আমরা চোখ দিবো রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীর ওপর। বাংলা সাহিত্য বিশ শতকের আগ পর্যন্তও নারীর আদিকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে কন্যা, জায়া ও জননীর বাইরে খুব কমই যেতে পেরেছে। বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত হাতে-গোনা যে কয়টি চরিত্র বাংলা সাহিত্যে নারী থেকে উত্তীর্ণ হয়েছিল বিনোদিনী তার মধ্যে অন্যতম। বিনোদিনীর পিতা বাড়িতে মেম রেখে তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। সমাজকে সংস্কারমুক্ত করার লক্ষ্যে সেই সময় ইউরোপীয় মিশনারি নারীরা বিনামূল্যে হিন্দু ঘরের মেয়েদের পড়াতেন। তাদের ধারণা ছিল, শিক্ষিত করে তুলতে পারলে মেয়েরা সামাজিক সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় আলোকপ্রাপ্ত নারী বিনোদিনী।

তার পড়া আছে বঙ্কিম থেকে শুরু করে দীনবন্ধু পর্যন্ত। আর এসব শিক্ষা বিনোদিনীর মধ্যে জাগ্রত করেছে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিত্ববোধ এবং বিচক্ষণতা। যার প্রতিফলনে আমরা দেখি উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই বিনোদিনীকে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সম্মান করে, সমীহ করে। বিনোদিনীকে মনে হয় ব্যতিক্রম। সাধারণ যে সমাজ তা মানুষের নানান চরিত্রের মধ্যে কেবল সেই জায়গায় বা প্রেক্ষাপটেই আলো ফেলে, যে প্রেক্ষাপট সমাজ সহজেই মেনে নেয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনীর মাধ্যমে সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আলো ফেলেছিলেন মনের গহীন অন্ধকারে।

বিনোদিনীকে ফুটিয়ে তুলতে বিশ শতকের গোড়ার দিকের এ উপন্যাসের কাহিনীতে নবজাগরণের আলোকপ্রাপ্ত যুবকদের এক প্রান্তে ছিল বিহারী; আর অপর প্রান্তে মহেন্দ্র। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। সে পরকীয়ার মাধ্যমে অনুভব করেছিল আপন সংস্কৃতি-চেতনার প্রতিচ্ছবি। যদিও স্ত্রী আশালতাকে নিয়েও সে পরিতৃপ্ত ছিল; কিন্তু নিজের শিক্ষিত চেতনাকে সন্তুষ্ট করতে সমচেতনার শিক্ষিত বিনোদিনীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কারণ উনিশ শতকের নব্য ধ্যান-ধারণার ফলে নব্য শিক্ষিতরা স্ত্রীকে মানসিক সঙ্গী হিসেবে পাওয়ার তাগিদ অনুভব করেছিল। কিন্তু মহেন্দ্রর প্রতি বিনোদিনীর আকৃষ্ট হওয়ার কারণ ভিন্ন। দীর্ঘদিনের সামাজিক অবহেলাই তাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে মহেন্দ্রর জীবনের দিকে ধাপিত করে। বিনোদিনী আকৃষ্ট হয়েছিল বিহারীর প্রতিও। তবে এক্ষেত্রে কারণ প্রতিহিংসা নয়; বরং বিহারীর মধ্যে আপন সত্তার বিকশিত প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া।

এই হলো আমাদের চিত্রকল্পে উপন্যাস চোখের বালির তিনটি চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। এবার সিনেমাতে আমরা এই তিনটি চরিত্রকে দেখার চেষ্টা করবো। তবে আমাদের দৃষ্টি প্রধানত বিনোদিনীর দিকেই থাকবে। প্রথমেই দেখি উপন্যাসে বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রর সাক্ষাত কীভাবে হয়েছিল। ‘শরৎকালের স্বচ্ছ নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে বিনোদিনী মহেন্দ্রর নির্জন শয়নগৃহে বসিয়া আশাকে কার্পেটের জুতা বুনাইতে শিখাইতেছিল।... ইতিমধ্যে নিঃশব্দ পদে বিনোদিনীর পশ্চাতে দ্বারের নিকট মহেন্দ্র আসিয়া দাঁড়াইল।’ আর সিনেমাতে বিনোদিনীর সাথে মহেন্দ্রর সাক্ষাত ঘটে এক রাতে। স্ত্রী আশালতার সাথে প্রণয়ের ঠিক আগে; দরজা বন্ধ করতে গিয়ে। মহেন্দ্রর চোখ প্রথমেই পড়ে বিনোদিনীর বস্ত্রহীন পিঠে। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে দেখতে পেয়ে সাদা আঁচল দিয়ে পিঠ ঢাকার চেষ্টা করে। রবীন্দ্রনাথ মহেন্দ্রকে দেখালেন বিনোদিনী কার্পেটের জুতা তৈরি করছে; আর ঋতুপর্ণ দেখালেন তার বস্ত্রহীন পিঠ। অর্থাৎ, এক জায়গায় নারীর দক্ষতা, অন্য জায়গায় দেহ।

চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কাহিনীকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উপস্থাপনের অধিকার নির্মাতার থাকে। সেটি করা হয় চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে, নান্দনিকতার প্রয়োজনে। কিন্তু ঋতুপর্ণ যেটি করলেন সেটি চোখের বালির কোন্ জায়গায় পূর্ণতা এনেছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হয় নি।

উপন্যাসে মহেন্দ্র ও বিনোদিনীর মধ্যে দ্বিতীয় সাক্ষাত ঘটে আশালতার শোবার ঘরে। বিনোদিনী একদিন আশার ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর আশা ও মহেন্দ্র মিলে বিনোদিনীর ছবি তুলতে গেলে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং সেই সুবাদে কথা হয়। আর সিনেমা চোখের বালিতে দ্বিতীয় সাক্ষাতটি ঘটে বাগান-বাড়িতে চড়ুইভাতি খেতে গিয়ে। বিনোদিনী পায়ের কাঁটা বের করতে নিজেই মহেন্দ্রর সাথে কথা বলে। মহেন্দ্র উপন্যাসে বিনোদিনীর কাছে আসে নিজের আগ্রহ থেকে; এক ধরনের অনুমতি না নিয়েই এবং খানিকটা পরিকল্পনা করে। সেখানে বিনোদিনীর ব্যক্তিত্ব একটা বড় কারণ। এছাড়া আশালতার পরিকল্পনা ছিল, বিনোদিনী তাদের ঘরে এসে ঘুমিয়ে গেলেই মহেন্দ্র ও সে মিলে বিনোদিনীর ছবি তুলবে। কিন্তু ঋতুপর্ণ প্রথম সাক্ষাতের বেলায় যেমন মধ্যরাতে বিনোদিনীকে মহেন্দ্রর শোবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন এক্ষেত্রেও তাই করলেন। বিনোদিনীকেই এগিয়ে নিয়ে আসলেন সাক্ষাতের জন্য। তাও কথা বলার জন্য নয়, পায়ের কাঁটা তুলে নেয়ার জন্য।

পরবর্তিতে উপন্যাসে দেখা যায়, মহেন্দ্র এবং বিনোদিনীর মধ্যে প্রতিনিয়তই দেখা হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রথমে মানসিক এবং পরে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এবং দুটি সম্পর্ক গড়ে ওঠার মাঝখানের সময়কাল দীর্ঘ। এখানে উপন্যাসের কাহিনী ধরে ধরে আলোচনা করা যাচ্ছে না, কারণ আলোচনা উপন্যাস নিয়ে নয়, সিনেমা চোখের বালি নিয়ে। শুধু উপন্যাসের দুটি লাইন তুলে দিয়ে সম্পর্ক ও সময় সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দেওয়া যেতে পারে; ‘মহেন্দ্র এইরূপে আহারে ও আচ্ছাদনে, কর্মে ও বিশ্রামে, সর্বত্রই নানা আকারে বিনোদিনীর সেবাহস্ত অনুভব করিতে লাগিল।’

অথচ দেখুন, ঋতুপর্ণের চোখের বালি’তে মানসিক সম্পর্কের আগেই তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে শারীরিক সম্পর্ক। সিনেমা ক্ষেত্রে সময়ের উপস্থাপন, সময়কে তুলে ধরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ঋতুপর্ণ সেটা না করে, কেন জানি অন্য পথে হেঁটেছেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব যেখানে, সেই মানসিক দ্বন্দ্ব, টানাপোড়ান পরাজিত হয়েছে ঋতুপর্ণের কাছে প্রাধান্য পাওয়া শারীরিক সম্পর্ককের কাছে।

প্রথম দুটি সাক্ষাতের ক্ষেত্রে উপন্যাস এবং সিনেমার মধ্যে আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, রবীন্দ্রনাথ দুবারই বিনোদিনী-মহেন্দ্রর সাক্ষাত ঘটিয়েছেন আশালতার উপস্থিতিতে। তাই মহেন্দ্র ও বিনোদিনী একে অন্যকে জেনেছে মানসিক মানদণ্ডে। আর ঋতুপর্ণ প্রথম দুটি সাক্ষাতে বিনোদিনী ও মহেন্দ্রর বাইরে সেখানে তৃতীয় কাউকে রাখেন নি।

পরকীয়া এবং মহেন্দ্র-বিনোদিনীর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি উপন্যাসেও ছিল। তার কারণও আমরা আগেই বলেছি। কিন্তু ঋতুপর্ণের চোখের বালিতে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, বিনোদিনীর সেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, বিচক্ষণতা ও ব্যক্তিত্ববোধের চেয়ে মহেন্দ্রকে বেশি আকৃষ্ট করেছে তার রূপ এবং যৌবন। পক্ষান্তরে উপন্যাসের অসম্ভব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বিনোদিনীকে চলচ্চিত্রে মনে হয়েছে কামুক নারী। ফলে বিনোদিনীর প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবটাও থেকেছে উপেক্ষিত।

এর বাইরে বিনোদিনীর আরও কিছু বিক্ষিপ্ত উপস্থাপনের কথা না বললেই নয়। ব্লাউজ পরা শেখানোর সময় বিনোদিনীর শারীরিক উপস্থাপন পুরো সিনেমাতে তার ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিকে ম্লান করে দেয়। এই দৃশ্যে বিনোদিনীকে প্রায় অর্ধ-নগ্ন করে উপস্থাপন করেন ঋতুপর্ণ। কাহিনীর প্রয়োজনে বিনোদিনীর ধবধবে পিঠ, কামুক বাহুর প্রদর্শন ঋতুপণের কাছে প্রয়োজনীয় হলেও দর্শক হিসেবে আমাদের কাছে ছিল না। দৃশ্যটিকে একটু সেমিওলজিক্যাল পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার হবে। প্রথম শটে বিনোদিনীর উন্মুক্ত ধবধবে পিঠ; দেখে বোঝা যায় তার বুকও উন্মুক্ত। দ্বিতীয় শটে উন্মক্ত পিঠের আংশিক দখল করে নেয় টকটকে লাল ব্লাউজ; শেষ শটে ব্লাউজ পরা অবস্থায় সামনে থেকে দেখা যায় বিনোদিনী রূপী ঐশ্বরিয়াকে। প্রথম শটের উন্মক্ত বুক, তৃতীয় শটে ব্লাউজে ঢেকে বের হয় দর্শকদের সামনে। শটগুলো দেখে যশোধরা রায়চৌধুরীর কিছু কথা না বলে পারছি না। ‘পর্ণোগ্রাফির মেয়েরা’ নামে একটি প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ নগ্নতা পর্নোগ্রাফিতে অসম্ভব, কারণ তা পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্য বানচাল করে দেয়। অর্ধ-আলোক, ছায়াময়তা এবং আধা-দেখা-যাওয়া নগ্নতাই পর্নোগ্রাফির উপজীব্য, কারণ সম্পূর্ণ নগ্নতায় যে অন্যমনস্কতা ও সারল্য আছে তা সুড়সুড়ি দেয় না। জারোয়া মহিলা নয়, মমতা কুলকার্নিই পর্নোগ্রাফির কাছের লোক।’ ঐশ্বরিয়া চোখের বালিতে মমতা কুলকার্নির জায়গায় অবতীর্ণ হয়েছেন কি না, তা নতুন করে ভাববার অবকাশ রাখে।

এছাড়া বিনোদিনীর চরিত্রে অভিনয় করা ঐশ্বরিয়া রায়কে নিয়েও আমাদের আপত্তি আছে। এই ঐশ্বরিয়ার নায়িকা হওয়ার ইতিহাস অনেকেরই জানা। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর শুরু হওয়া বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বহু-ভোক্তার দেশ ভারতকে একটি বাজার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সেই বাজারে পণ্য বিক্রি করতে সেসময় প্রয়োজন হয়ে পড়ে একগুচ্ছ সুন্দরীর, যারা পণ্যের গুণাবলীর বাইরে গিয়ে ওই পণ্যের প্রতিনিধিত্বকারী হয়ে উঠবেন। এরই হাত ধরে ঐশ্বরিয়ার প্রথমে বিশ্বসুন্দরী ও পরে নায়িকা হয়ে ওঠা। এই আলোচনা অবশ্য এখানে না বাড়ানোই উচিত। কিন্তু প্রাসঙ্গিকতা এড়াতে পারছি না। সত্যজিৎ রায়ের ঘরে-বাইরে সিনেমায় মক্ষী চরিত্রে অভিনয় করা স্বাতীলেখা চট্টোপাধ্যায়কে কিন্তু বিশ্বসুন্দরী হতে হয় নি। বরং যেটি করতে হয়েছে যে, অভিনেত্রী স্বাতীলেখার নিজের মধ্যে মক্ষীকে ধারণ করতে হয়েছে। চোখের বালি উপন্যাসে পাঠকের কল্পনার যে বিনোদিনী, সেই বিনোদিনীর জন্য হয়তো আরেকজন স্বাতীলেখার দরকার ছিল। কেননা শারিরীক সৌন্দর্য্য বিনোদিনীর জন্য মুখ্য ছিল না, ছিল মানসিক সৌন্দর্য্য। যা ঐশ্বরিয়া ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। আর এই ব্যর্থতা সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়নকে পরবর্তী পরিচালকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করেছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।

৩.
চলচ্চিত্রের দর্শক হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকলেও; সমালোচক হিসেবে আমাদের তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। তাও আবার রবীন্দ্রনাথ, ঋতুপর্ণ বলে কথা। তারপরও নেহাত আগ্রহের বশে এই সমালোচনাটি লেখা। আসলে সমালোচনা বললে ভুল হবে, ওই যে আমরা বলেছিলাম খটকা এবং সংশয়; যা আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। আর যে বিনির্মাণের কথা ঋতুপর্ণ বলেছেন, সেটি যদি খুব সহজেই বোধগম্য হতো তাহলে চোখের বালি’র এই মূল্যায়ন আমরা অন্যভাবে লিখতে বাধ্য হতাম। এবং সেক্ষেত্রে একথা বলতে দ্বিধা থাকতো না যে, ঋত্বিক ঘটক যেমন সুবোধ ঘোষের বক্তব্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, ঋতুপর্ণও তেমন রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন।

লেখক : উৎকলিকা দাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের চতুর্থ বর্ষ, দেবাশীষ কে. রায় এবং আসাদ লাবলু গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকত্তোর পর্যায়ের শিক্ষার্থী। আসাদ লাবলু লেখাপড়ার পাশাপাশি দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত।


তথ্যসূত্র

১. সাক্ষাতকারটি সামহয়ারইন ব্লগ থেকে নেওয়া; অনুবাদক মুহাম্মদ। ২০০৫ সালের ৯ এপ্রিল ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘সাউথ এশিয়া হিউম্যান রাইট্স ফিল্ম ফেস্টিভাল’এ যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক যান। সেসময় সাক্ষাতকারটি নেন ‘এশিয়া সোর্স’এর এর ঘবৎসববহ ঝযধরশযা।

২. প্রাগুক্ত, ২০০৫, ঋতুপর্ণ; অনুবাদক মুহাম্মদ।

৩. প্রাগুক্ত, ২০০৫, ঋতুপর্ণ; অনুবাদক মুহাম্মদ।

৪. রায়চৌধুরী, যশোধরা; ‘পর্নোগ্রাফির মেয়েরা’; তেহাই; সম্পাদক- সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুযারি-মার্চ, ২০০৯, কলকাতা।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন