Magic Lanthon

               

আসাদ লাবলু

প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

টক-শো নিয়ে দু-চারটি ‘টক-কথা’

আসাদ লাবলু


কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে আধেয় যেমন তার অন্তর্গত বস্তুপুঞ্জ, তেমনি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আধেয় তার অনুষ্ঠানপুঞ্জ। যে অনুষ্ঠানপুঞ্জের মাধ্যমে বোঝা যায় ওই চ্যানেলের সামগ্রিক চরিত্র। অর্থাৎ কোনটি নিউজ চ্যানেল, কোনটি স্পোর্টস চ্যানেল বা কোনটি বিনোদন চ্যানেল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল বাদ দিলে বাকি চ্যানেলগুলোতে আমরা একই ধরনের কিছু অনুষ্ঠান পাই। যেমন, সংবাদ, সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি আরও যে অনুষ্ঠান প্রত্যেক চ্যানেলে পাওয়া যায় সেটির নাম টক-শো। বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় প্রতিটি চ্যানেলেই দেখা মিলবে এই টক-শো’র। যে কেউ চাইলে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টার যেকোনো সময় রিমোট-কন্ট্রোল নিয়ে আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোতে একবার ঘুরপাক দিয়ে দেখতে পারেন। কোনো না কোনো চ্যানেলে আপনি অবশ্যই টক-শো দেখতে পাবেন।

বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলে টক-শো’র এই অতি উপস্থাপন আপাত নতুন মনে হলেও এর শুরু কিন্তু ৬০ বছর আগে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, আমেরিকান মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জে. ফ্র্যাঙ্কলিনের হাত ধরে ১৯৫১ সালে টক-শো যাত্রা শুরু করে। WJZ টিভিতে শুরু হওয়া ওই টক-শো পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে মোটা দাগে যে তিন ধরনের টক-শো রয়েছে তার মধ্যে ‘লেটনাইট’ টক-শো’ই আমাদের এখানে বেশি জনপ্রিয়। এর বাইরে ‘ডাইনামিক’ ঘরানার টক-শো’গুলো আমাদের এখানে, এমনকি কোনো দেশেই তেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি। তবে ‘ট্যাবলয়েড’ টক-শো আমাদের এখানে না হলেও ইউরোপের দেশগুলোতে বেশ জনপ্রিয়। এই ধরনের টক-শো’তে বেশ কয়েকজন সাধারণ দর্শককে অতিথি করে আনা হয়। অতিথিরা এখানে তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

প্রকারভেদ থাকলেও এসব টক-শো’র কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন, টক-শো’গুলোর আলোচনার বিষয় থাকে সাধারণত জাতীয়-আন্তর্জাতিক কোনো চলমান ইস্যু। এখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞের পাশাপাশি থাকেন একজন সঞ্চালক। এরা সবাই মিলে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে সমস্যাটির নানা দিক নিয়ে ‘গুরু-গম্ভীর’ আলোচনা করেন। পাশাপাশি চেষ্টা করেন একটা সমাধান দেওয়ারও।

এসব টক-শো তাদের সামগ্রিকতায় দাবি করে যে, তারা সবদিক দিয়ে ‘ঠিক’ আছেন! যদিও ঠিক-বেঠিকের বিষয়টির বিচার আপেক্ষিক, এমনকি জটিলও। তবে অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ হলো- মনোযোগ সহকারে এবং চোখটা হাতের তালুর নিম্নাংশ দিয়ে একটু ডোলে এসব টক-শো দেখা। এবং দেখার পর হুবহু তা তুলে ধরা। এতে করে মনে হয় পাঠক কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও এর মূল্যায়ন করতে পারবে।

দ্যাখো রে নামেরও বাহার

‘ডিভাইন গ্রুপ আমাদের গণতন্ত্র’। পাঠক, বিভ্রান্ত হবেন না। আমি ডিভাইন গ্রুপকে আমাদের গণতন্ত্র বানাচ্ছি না, মানছিও না, বা আপনাদেরকেও মানতে বলছি না। এটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভি একটি টক-শো’র নামের বাংলা অনুবাদ। ইংরেজি নামটা বলে নেওয়া ভাল- ‘ডিভাইন গ্রুপ আওয়ার ডেমোক্রেসি’। রবি থেকে বৃহস্পতি এই পাঁচ দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এটি প্রচারিত হয়। কোনোদিন আবার সাতটা ৫০ বেজে যায়। ঢাকা শহরে যে যানজট তাতে অতিথিরা হয়ত সময় মতো পৌঁছতে পারে না, তাই নির্দিষ্ট সময় অনুষ্ঠান শুরু করা সম্ভব হয় না। যাই হোক, সেটি আমাদের গণতান্ত্রিক সমস্যার ফল। ‘ডিভাইন গ্রুপ আমাদের গণতন্ত্র’র সমস্যা নয়।

চ্যানেল আই টক-শো’র কথাও বলা যায়। এটির নাম- ‘গ্রামীণ ফোন তৃতীয় মাত্রা’। এটিএন বাংলায় প্রতি সোমবার রাত ১২টার পর প্রচারিত হয় ‘এইচআরসি এনার্জি পাওয়ার সেভিং বাল্ব, যে কথা কেউ বলে নি’। এছাড়াও একুশে টেলিভিশন এ ‘একুশের রাত’, দেশ টিভিতে ‘সোজা কথা’, বাংলাভিশন এ ‘আরএকে সিরামিক নিউজ এন্ড ভিউজ’ ও ‘মনের কথা’, বৈশাখী টিভিতে ‘জিরো আওয়ার’ ও ‘রিপোটার্স ডায়েরি’, এটিএন নিউজ এ ‘নিউজ এক্সট্রা’, মাছরাঙ্গা টিভির ‘প্রাইম ইস্যু’, সময় টিভি ‘সম্পাদকীয়’।

নামগুলো দেখে মনে হয় প্রতিটি নামের মধ্যেই একধরনের ‘অহম-অহম’ ভাব আছে। পাঠক, সবগুলো নামের যদি ভাব খোঁজার চেষ্টা করেন তাহলে মনে হয় ওই এটিএন বাংলার টক-শো ‘যে কথা কেউ বলে নি’র মতোই ভাবার্থ পাবেন। দেশ টিভি ‘সোজা কথা’ই ধরুন। মানে, কে কী মনে করল বা কার কী এল-গেল, তা দেখার সময় নেই। ভয়-ভীতি, স্বার্থ সবকিছু উপেক্ষা করে যা ন্যায্য তা সোজাসুজি এই টক-শো’তে তুলে ধরা হয়। আবার, বাংলা ভিশন ‘মনের কথা’র একই অবস্থা। আপনি যা মনে মনে ভাবেন, অথচ কেউ বলে না-এমন কথাই এখানে পাবেন!

দর্শক এখানে দুধ-ভাত

দুধ-ভাত বিষয়টি একটু খুলে বলা দরকার। খুব ছোটবেলায় অপেক্ষাকৃত বড়দের সাথে গোল্লাছুট খেলতে চাইতাম। ছোট বলে খেলায় রাখত না বড়রা। বাধ্য হয়ে কান্নাকাটি থেকে শুরু করে খেলায় নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতাম। ফলে বাধ্য হয়ে বড়রা আমাদের অর্থাৎ তৎকালীন ছোটদের খেলায় রাখত। কিন্তু যখন দৌড়াতাম তখন প্রতিপক্ষের কেউ আমাদের ছুঁতো না। কারণ হিসেবে সাথে সাথেই জানতে পারতাম, আমাদের আসলে এমনি খেলায় রাখা হয়েছে। আর এই এমনি-এমনি খেলায় রাখার নামই হলো ‘দুধ-ভাত’।

যাই হোক, এবার গোল্লাছুট থেকে টক-শো’তে আসা যাক। ২০ অক্টোবর আরটিভি ‘ডিভাইন গ্রুপ আওয়ার ডেমোক্রেসি’র কথাই ধরি। সেদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ঢাকাকে দুই ভাগে বিভক্ত করা সংক্রান্ত। শুরুর দিকে আরিফুর নামের এক দর্শক অনুষ্ঠানের অতিথি এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে যে প্রশ্নটি করেন তা এরকম- ‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। এটা কি নাগরিকদের সুব্যবস্থা করার জন্য, নাকি এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত? আর যদি দুই ভাগে বিভক্ত করা হয় তাহলে উত্তর ও দক্ষিণ দু’টি দুই পর্যায়ে হয়ে যাবে না? উত্তর হয়ে যাবে ধনীদের জন্য আর দক্ষিণ হয়ে যাবে গরীবদের জন্য। এটি কি আসলে সুব্যবস্থা, নাকি রাজনৈতিক চাল?’

প্রশ্নটিকে সঞ্চালক সুস্পষ্ট হিসেবে মন্তব্য করেন এবং তার উত্তর দেওয়ার জন্য মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরও প্রশ্নকারী দর্শক তার উত্তর পেয়েছিলেন কি না জানি না, তবে আমি পাই নি।

পাঠক, চাইলে এই ঘটনাটিকে আপনি নমুনা হিসেবে ধরতে পারেন। কারণ প্রতিটি টক-শো’তেই কম-বেশি আম-দর্শককে এরকম অবহেলিতই থাকতে হয়। দর্শক ফোন করলে অনেক ক্ষেত্রে কথা শেষ করার আগেই ফোন লাইন কেটে দেয়া হয়; না হয়, প্রশ্ন আমলেই নেয়া হয় না। কোনো কোনো সময় প্রশ্ন শোনার পর কেন জানি অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিরতি হয়, ফিরে এসে আর সেই প্রশ্নের কথা মনে থাকে না। অথচ উপরিতলে বলা হয়, সবকিছুই এই আম-দর্শকদের জন্যই। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর থেকে বড় বড় অক্ষরে ফোন নম্বরগুলো ভাসতে থাকে। ভাবখানা এমন- এই নম্বরে ফোন করে দর্শক আপনি এ অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে উঠতে পারবেন! কিন্তু গণমাধ্যমের সব ধরনের ভাবের সাথে বাস্তবতার বড় ফারাক। তারপরও তারা সবসময় জনগণকে পাশে রাখে; কেন রাখে, তার উত্তর ছোটদের দুধ-ভাত হিসেবে খেলায় পাওয়া যায়।

ওরে কত কথা বলে রে!

একজন সঞ্চালকের কাজ কী? খুব সাদামাটাভাবে আমরা যেটা বুঝি- সঞ্চালকের কাজ হলো সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানটি চালিয়ে নেওয়া অর্থাৎ সঞ্চালিত করা। তিনি দেখবেন, অনুষ্ঠানটি সঠিকভাবে বা ‘লাইনমতো’ চলছে কি না। যেমন, কোনো অতিথি বা আলোচক যদি কথা বলতে বলতে বিষয়বস্তুর বাইরে চলে যান, তবে সেই আলোচক বা আলোচনাকে আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আনার দায়িত্ব সঞ্চালকের ওপর বর্তায়। আরও একটা বিষয় হলো- সঞ্চালককে মনে রাখতে হবে তিনি আলোচক নন, সঞ্চালক। কিন্তু বেশ কয়েকটি টক-শো’তে আমরা দেখেছি যে, সঞ্চালক নিজেই আলোচক বনে যান। তিনি সে বিষয়ে কতটা জানেন কিংবা জানেন না সেটি বিবেচ্য বিষয় থাকে না। কথা বলার সুযোগ পেলেই, তিনি কথা বলতে শুরু করেন।

আরটিভি ১১ অক্টোবর ২০১১ এর টক-শো’র কথাই ধরা যাক। অতিথি ছিলেন সেতু বিভাগের সচিব মোশারফ হোসেন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলী খান। সঞ্চালক একটি বিষয় জানতে চাওয়ার সাথে সাথেই মোশারফ হোসেন সঞ্চালকের উদ্দেশে বললেন, ‘আমাকে কিন্তু এক মিনিট বলতে দিতে হবে, নইলে আমি বিষয়টি পরিষ্কার করতে পারব না।’ তার এই আকুতির কারণ- এই পরিস্থিতির আগেই সঞ্চালক একাধিকবার তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিজের মতো করে কথা বলেছেন। মোশারফ হোসেন বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে শেষ করতে দিন, নইলে বুঝতে পারবেন না।’ কিন্তু সে সুযোগটুকু মোশারফ হোসেনকে দেয়া হয় নি।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে- সঞ্চালক যদি সেই বিষয়ে জানেন, তাহলে কথা বলবেন না কেন? উত্তর, তিনি জানলেও আলোচকের সমপরিমাণ কথা বলবেন না। কোনো বিষয়ের টক-শো সঞ্চালনা করার জন্য অবশ্যই একজন  সঞ্চালককে কিছু পড়াশুনা করে আসতে হয়। সেটা হয়ত তিনি করেনও, কিন্তু তার মানে এই নয় তিনি আলোচক হয়ে যাবেন। কারণ তিনি বিশেষজ্ঞ নন। আবার অনেক সময় না জেনে কথা বলতে গিয়ে সঞ্চালক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ে যান। আরটিভি ১১ অক্টোবর ২০১১ এর টক-শো টির কথাই ধরি, সঞ্চালক গোলাম মর্তুজা একটা মন্তব্য করে আকবর আলী খানের হাতে ‘ধরা’ খান। বিষয়টি এমন- সঞ্চালক পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে একপর্যায়ে হঠাৎ করে বায়বীয় ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন। এই ‘বায়বীয়’ কথার আপত্তি জানান আকবর আলী খান। তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেন অভিযোগটি মোটেও বায়বীয় নয়। এতে অনেকখানি অস্বস্তিতে পড়েন সঞ্চালক। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, সঞ্চালক মন্তব্য করার কে? তিনি কেবল শুনবেন, কম বলবেন আর অন্যকে বলার সুযোগ করে দিবেন।

এবার আরেকটি নমুনার কথা বলি। ‘গ্রামীণ ফোন তৃতীয় মাত্রা’ অনুষ্ঠানের ২৯৯৮ পর্ব। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে সঞ্চালক জিল্লুর রহমান কথা শেষ করার জন্য বারবার সাবেক মন্ত্রী শাহ্‌জাহান সিরাজের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছিলেন। যদিও শাহ্‌জাহান সিরাজ তখনো কথা শেষ করতে পারেন নি। এসময় জিল্লুর রহমানের অঙ্গভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, অনুষ্ঠানের সময় বুঝি পেরিয়ে গেছে। আর মনে হবেই না কেন, শাহ্‌জাহান সিরাজের কথা চলাকালীনই টেলিভিশনের পর্দায় নানান ঠিকানা ভেসে উঠতে থাকল। আর তা দ্রুত পড়েও যাচ্ছিলেন সঞ্চালক। মূলত এগুলো ছিল এই অনুষ্ঠান সম্পর্কে দর্শক কীভাবে মতামত জানাতে পারেন তারই দিকনির্দেশনা। ভাবলাম, এইবার মনে হয় টক-শো শেষ। কিন্তু শেষ হলো না। এরপর জিল্লুর রহমান পাক্কা চার মিনিট আট সেকেন্ড উপসংহার টানলেন। আর তিনি উপসংহারে যেসব কথা বললেন, সেগুলো ইতিমধ্যে সেই টক-শো’তেই আমন্ত্রিত আলোচকদ্বয় বিস্তারিত বলে ফেলেছেন।

যাই হোক, একটু কথা ঘুরাই। এই সঞ্চালকরা কিন্তু গণমাধ্যম-পক্ষ। তারা আসলে সবকিছু তাদের মতো করে করতে চান। কে কথা বলবে, কীভাবে বলবে, কোন কথা বলবে- সবকিছুই তাদের উপর নির্ভর করে। যে কারণে কথা থামিয়ে দেওয়া, নিজের মতো করে বলা, দর্শককে এমনি-এমনি অনুষ্ঠানে রাখা ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপনই বড় অতিথি

বিজ্ঞাপনের সময় এলে বিজ্ঞাপন হবেই। এই সময় টক-শো’র পরিস্থিতি বা আলোচনা কোন পর্যায়ে আছে তা বড় কথা নয়। বিষয়টি পরিষ্কার করি। টেলিভিশনে যেকোনো অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় দর্শকদের জন্য, আর তা পরিবেশিত হয় বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সৌজন্যে। কিন্তু আমরা দেখি, অনুষ্ঠানগুলোতে ‘দর্শকের জন্য’র চেয়ে বিজ্ঞাপনের ‘সৌজন্য’র গুরুত্ব অনেক বেশি। সেটা হলো- অতিথি বা আলোচকরাও বিজ্ঞাপন বিরতির কথা শুনলেই কেমন জানি সাথে সাথে চুপ মেরে যান। আলোচক মনে হয় মেনেই নিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে তার কিছুই করার নেই। কিংবা তিনি হয়ত ওই পক্ষ মানে, গণমাধ্যম পক্ষেরই প্রতিনিধি। পাঠক, প্রশ্ন করতে পারেন- হঠাৎ করে এমন গুরুতর অভিযোগ করে বসলাম কেন? একদম এমনি-এমনিই তো আর করি নি। বছরের ৩৬৫ দিন টক-শো দেখি, আপনারাও দেখেন। কিন্তু এমন কি কোনো টক শো দেখেছেন যেখানে গ্রামীণ ফোনের রাজস্ব ফাঁকি থেকে শুরু করে ভোক্তাদের ভোগান্তি সংক্রান্ত কোনো কথা হয়েছে? অথবা, রিয়েল স্টেট ব্যবসার ফাঁকিবাজি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে? বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা হতে পারে। সে সুযোগ রইল।

টক-শো চলাকালীন হঠাৎ করেই বিজ্ঞাপন দেওয়ার আরও একটা বড় অসুবিধা আছে। প্রায় প্রতিটি টক-শো’ই সরাসরি সম্প্রচার হয়। অনেক সময় এই সরাসরি আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আলোচককে বিজ্ঞাপন দিয়ে থামিয়ে দেয়া হয়। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আলোচনা আর আগের গতিতে ফিরে আসতে পারে না। কিন্তু ‘অসহায়’ আলোচকরা হাসি হাসি মুখে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত থাকেন। এক্ষেত্রে তাদের ‘মুড’ আর নষ্ট হয় না!

আরটিভি এই টক-শো’র যেকোনো পর্বেই পাঠক খেয়াল করলে দেখবেন, টিভি-পর্দার উপরের দিকে ডানে ‘আল-আমিন’ (কসমস) বিস্কুটের একটি প্যাকেট ঘুরছে। নিচের দিকে সঞ্চালক আর আলোচকের মাঝ দিয়ে দেখতে পাবেন ডিভাইন গ্রুপের লোগো। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল যেভাবেই থাকুক না কেন, ‘ডিভাইন গ্রুপ আওয়ার ডেমোক্রেসি’ লেখা দেখতে পারবেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো, আওয়ার ডেমোক্রেসি লেখাটা পুরোপুরি দেখা না গেলেও কিন্তু ডিভাইন গ্রুপটা স্পষ্টই দেখা যায়।

‘সুপার স্টার এনার্জি সেভিং বাল্ব যে কথা কেউ বলেনি’ অনুষ্ঠানেরও একই অবস্থা। সেখানে উপস্থাপিকার পিছনে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, ‘সুপার স্টার এনার্জি সেভিং বাল্ব’ এর মহড়ায় ‘যে কথা কেউ বলেনি’ কতটা মামুলি! অর্থাৎ, বিজ্ঞাপনের আসন কিন্তু পাকাপোক্ত। তাহলে কী বলবেন? বিজ্ঞাপনই কি অনুষ্ঠানের বড় অতিথি নয়?

যে কথা কেউ বলে নি

সঞ্চালকের প্রশ্নটা এরকম- ‘আরেকটা চিত্র আমাদের দেশে খুব দেখা যায় নিম্ন মধ্যবিত্তদের মধ্যে, তারা লিভার রোগ হলেই ঝাড়ফুঁক কবিরাজি করে; তো এগুলোতে কি লিভার রোগ ভাল হয়?’ বাংলাদেশ লিভার ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী কয়েকটি কথা বলে এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘না কোনো লাভ হয় না’। এরপর সঞ্চালক মোটামুটি একটা সারকথা টেনে বললেন, ‘তার মানে ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি-পানি ট্রিটমেন্ট এগুলো বাস্তবসম্মত কোনো চিকিৎসা নয়, আমরা আপনার আলোচনা থেকে তা জানতে পারলাম।’

এই হলো গত ১৪ নভেম্বর এটিএন বাংলায় রাত সাড়ে এগারটায় প্রচারিত টক-শো ‘যে কথা কেউ বলেনি’ এর আলোচনার একাংশ। এখন আপনারাই বলুন, এই আলোচনার মধ্যে এমন কিছু কি কোনো কথা আছে ‘যে কথা কেউ বলেনি’। অথচ অনুষ্ঠানের নাম দেখে একজন সাধারণ দর্শক ভাবতেই পারেন, এখানে না জানি কত মহামূল্যবান আলোচনা হবে!

আচ্ছা, এত রাত জেগে দেশ ও দেশের বাইরের যে শ্রেণীর মানুষ একবিংশ শতাব্দিতে এসে এই টক-শো দেখেন তারা কি জানেন না; ঝাড়ফুঁকে লিভার রোগের চিকিৎসা হয় কি না হয়! ভূত-পেত্নির আছর অথবা কুসংস্কার নিয়ে টক-শো হলে তা-ও না হয়, একটা কথা ছিল! আর লিভার ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকই বা কেমন, যে তিনি এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য টক-শো’তে আসেন। যাই হোক পাঠক, পূর্ব-পরিকল্পিত একটি অনুষ্ঠানে এই ধরনের প্রশ্নের কোনো যৌক্তিকতা আছে কি? পূর্ব-পরিকল্পিত বলছি এই কারণে যে, হঠাৎ করেই তো আর অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার দুই মিনিট আগে অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয় নি, তাই না?

‘গ্রামীণ ফোন তৃতীয় মাত্রা’র ২৯৯৮তম পর্বের কথাই বলি। অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী শাহ্‌জাহান সিরাজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এম আতাউর রহমান। ওই দিন দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনায় উপস্থাপক জিল্লুর রহমানসহ তিনজনই দেশের রাজনৈতিক নানা সংকট নিয়ে কথা বলছিলেন। এই সংকটগুলো আমার মতো অনেক দর্শকই জানতেন একথা বলা যায়। অপেক্ষা করছিলাম সংকট থেকে উত্তরণের উপায় শোনার জন্য। শাহ্‌জাহান সিরাজের দাবি বা মতামত ছিল এরকম- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ঠিক করতে হবে এবং সবাইকে তা মানতে হবে। আর আতাউর রহমান গুরুত্ব দিয়ে বলছিলেন, তরুণ প্রজন্মের কথা। অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে বা দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বা আমার মতো অনেক দর্শকই আশা করেছিলেন যে, পর্যায়ক্রমে মনে হয় এই আলোচনায় এই নির্দেশনাও আসবে যে, আসলে কী উপায়ে ইতিহাস সর্বসাধারণ-স্বীকৃত হয় অথবা তরুণ প্রজন্ম কীভাবে দায়িত্বে আসতে পারেন। আবার রাজনৈতিক এই সংকটের জন্য আমাদের রাজনীতিকদের বাইরের কেউ দায়ী কি না ইত্যাদি। কিন্তু আলোচনায় তা আর পেলাম না। আলোচনা ওই দু’টি বিষয় বা বৃত্তের মধ্যে ঘোরাঘুরি করল ঠিকই কিন্তু গভীরে আর  গেল না। ভেবেছিলাম, নাম যেহেতু তৃতীয় মাত্রা, আলোচনা বা নির্দেশনাও মনে হয় থার্ড ডাইমেনশন বা তৃতীয় মাত্রা মানের হবে। কিন্তু আলোচনা হলো ঠিকই, মাত্রা আর এল না।

মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত

আজকের এই আলোচনায় আমি কয়েকটি টক-শো’র আলোচনার বিষয়বস্তু উল্লেখ করেছি। পাঠক খেয়াল করলে দেখবেন, প্রায় সবগুলো বিষয়ই সাম্প্রতিক। শুধু এগুলোই নয়, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সব টক-শো’র বিষয়বস্তুর হাল-হকিকত একই- সাম্প্রতিক। টক-শো’র বিষয়বস্তু সাম্প্রতিক হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক| তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। প্রশ্ন অন্য দু’টি জায়গায়।

প্রথমত, সব আলোচনাই তো সাম্প্রতিক হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের সমাজে এমন অনেক সমস্যা আছে যাকে বলা যায় মৌলিক। সেগুলো নিয়ে কিন্তু আলোচনা হয়-ই না বলা চলে। যতটুকু হয় সেটি ওই লিভার রোগের মতো ‘সস্তা’ বিষয় নিয়ে।

দ্বিতীয়ত, এমন কোনো মৌলিক সমস্যা টক-শো’গুলোতে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর যা সর্বসাধারণ স্বীকৃত; কিংবা যে সমস্যাগুলো অন্য অনেক সমস্যার জনক। টক-শো’তে এমন বিষয় উঠে আসে যেগুলোতে পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। অর্থাৎ, অতিথি কিংবা দর্শকদের এক পক্ষ মনে করেন এটি কোনো সমস্যা নয়, অন্য পক্ষ দাবি করেন এটি একটি সমস্যা। এই নিয়ে শুরু হয় তর্ক। শেষ পর্যন্ত তর্ক অনেক সময় এমন ‘কু-তর্কে’ রূপ নেয় যে তৎক্ষণাৎ টক-শো বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

এখন প্রশ্ন আসে, সব বিষয়বস্তুতে কেন পক্ষ-বিপক্ষের অস্তিত্ব থাকে? এটির মূলেও ওই দর্শক। কারণ দর্শককে ‘উত্তেজিত’ করতে পারলে বিজ্ঞাপনদাতাদের ‘শান্ত’ রাখা যায়।

আরেকটু বলব। একটু আগে বলছিলাম যে, মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় না। কথাটি একটু সংশোধন করা দরকার। একদমই যে বলে না, তা নয়; বলে। কিন্তু সে আলোচনার গভীরতা ওই পক্ষ তৈরি করা পর্যন্তই। এর বাইরে নয়।

নতুন তারকা টক-শো আর্টিস্ট

গণমাধ্যমে, বিশেষ করে বেসরকারি টেলিভিশনে নতুন এক জাতের তারকার নাম সম্প্রতি বেশ শোনা যাচ্ছে। টক-শো আর্টিস্ট। এখানে খুব সাধারণ অর্থে যা বোঝানো হচ্ছে- যারা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন টক-শো’তে অতিথি বা আলোচক হয়ে যাচ্ছেন তারাই টক-শো আর্টিস্ট। তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কতটা জানেন, সেটি বড় কথা নয়। তারা টক-শো’তে আসেন, আলোচনা করেন- এটাই বড় কথা। এখন, টক-শো’তে যারা আসেন তাদেরকে যদি বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, তাহলে মোটা কয়েকটি শ্রেণী-পেশার মানুষকে পাওয়া যাবে। এরা হলো- রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাবেক অথবা বর্তমান আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব অর্থাৎ বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক। আমাদের সমাজের নানান শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে থেকে কেবল হাতেগোনা এই কয়েকটি শ্রেণী-পেশার মানুষকেই পর্দায় দেখা যায়। অন্যান্য শ্রেণী-পেশার উপস্থিতি সেখানে নেই বললেই চলে। এই না থাকার পিছনে দু’টি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, অন্যদের আসার সুযোগ দেওয়া হয় না। দ্বিতীয়ত, কোনো না কোনো কারণে তারা এসব টক-শো’তে নিজ থেকেই আসেন না।

পাঠক, অন্যান্য শ্রেণী-পেশার কথা বাদই দিলাম, এই কয়েক ধরনের শ্রেণী-পেশার মানুষের সবাই যে টক-শো আসে তা নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানেই ঢাকা অথবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে কিন্তু এখানে সহজে খুঁজে পাবেন না। আবার, সরকারি আমলার ক্ষেত্রেও তাই। ঢাকার বাইরের কোনো আমলা টক-শো’গুলোতে কালেভদ্রেও মেলে না। এসব বাস্তবতায় কেউ যখন টক-শো’ওয়ালাদের বিপক্ষে এমন অভিযোগ করেন যে, টক-শো একটা করতে হবে, তাই তারা করেন; অত হিসাব-নিকাশ করেন না; তখন সেই অভিযোগ একেবারে ভিত্তিহীন বলা খুব সহজ হবে না।

যে কথা সবাই বলে

এই আলোচনায় আমি দাবি করছি না বা দাবি করতেও পারব না যে, বাংলাদেশের টক-শো’গুলোর সার্বিক অবস্থা এই! তবে ইতিবাচক বলেন, আর নেতিবাচক বলেন- এর ভিতরে এই দুর্বলতা-সবলতাগুলো বিদ্যমান। যদি পাঠক নেতিবাচক ধরেন, তাহলে এগুলো পরিবর্তন করা যেতে পারে অথবা করা প্রয়োজন। আর করতে পারলে সামগ্রিক টক-শো’র ইতিবাচকতার শতকরা হার বেড়ে যাবে বলে মনে হয়। যদিও এটি ¯^xKvi করতে হবেই যে, এই সমালোচনার বিষয়গুলোর খানিকটা বিদ্যমান সমাজ বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলেই হয়েছে। তাই এগুলো সমাজ বা অর্থনীতি ব্যবস্থার উর্ধ্বে উঠে পরিবর্তন করা সম্ভব নয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। ‘ডিভাইন গ্রুপ আওয়ার ডেমোক্রেসি’ থেকে শুধু ‘আওয়ার ডেমোক্রেসি’ অথবা, ‘গ্রামীণ ফোন তৃতীয় মাত্রা’ থেকে শুধু ‘তৃতীয় মাত্রা’ হওয়াটা অনেকটাই জটিল। কিন্তু ‘যে কথা কেউ বলে নি’ সেই কথা বা সেই কথা বলার মানুষ নির্বাচনের বিষয়গুলো বিবেচনা করতে মনে হয় খুব বেশি বেগ পাওয়ার কথা নয়।

 

লেখক : আসাদ লাবলু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ  সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী। এর পাশাপাশি তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন। 


asadmcru@gmail.com

তথ্যসূত্র

১.en.wikipedia.org/wiki/Talk_show

২.www.allfreeessays.com/topics/classification-talk-shows/0

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন