Magic Lanthon

               

ইলমাজ গু‘নে

প্রকাশিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

পরাজয়, ভুল ও প্রবঞ্চনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ইতিহাস : ইলমাজ গু’নে

ইলমাজ গু‘নে


‘ভেঙ্গে ফেল জানালা, যাতে পাখিরা নিজেদের মুক্ত করতে পারে’ এই কথার ওপর দাঁড়িয়েই ইলমাজ গু‘নে নির্মাণ করেছিলেন ইয়োল  (দ্য ওয়ে) চলচ্চিত্রটি। জেলের ভিতর বন্দীদের জীবনকে কেন্দ্র করে নির্মিত এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই গু‘নে তুলে ধরেছিলেন তুরস্কের সার্বিক পরিস্থিতি। মূলত স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের স্বপ্নই ছিল তার আমরণ চাওয়া।

তুরস্কের বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা ইলমাজ গু‘নে। যিনি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন কারাগারে। সাধারণ নিষ্পেষিত, নিপীড়িত মানুষের দাবি আদায়ে রাজপথে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী, সোচ্চার। আবার সমাজের নির্মম বাস্তবতাকে তুলে ধরার জন্য এবং তা বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার নিকট পৌঁছে দিতে চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করেছিলেন তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে। গু‘নের জীবনের চাওয়া ছিল তার দেশের মানুষের চূড়ান্ত স্বাধীনতা। দেশের জনগণের মুক্তিই ছিল তার পরম আরাধ্য। দেশের জন্য, দেশের জনগণের জন্য তিনি লড়াই করেছেন আমৃত্যু। সামরিক-শোষক যখন তুরস্ককে অস্থিতিশীল করতে লাগল, সারা দেশের মানুষ যখন অবর্ণনীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটাচ্ছিল ঠিক তখন মার্কসীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ মহান এই মানুষটি সব সত্যকে তুলে ধরলেন সেলুলয়েডের ফিতায়।

১৯৩৭ সালে তুরস্কের আদানায় জন্ম নেয়া ইলমাজ গু‘নে পড়ালেখা করেছেন আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইন ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশুনা করলেও ১৯৬৫ সালের দিকে চালু করেন চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। গু‘নে ১৯৭১ সালে এজিত চলচ্চিত্রটির জন্য সেরা পরিচালক হিসেবে গোল্ডেন বল অ্যাওয়ার্ড পান। ১৯৭৫ সালে য়েন্ডআইজ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের জন্য পান গোল্ডেন অরেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড। ১৯৮১ সালে গু‘নে জেল থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে চলে যান। আমৃত্যু আর দেশে ফিরতে পারেন নি গু‘নে। সেখানেই ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪ সালে বিপ্লবী এ চলচ্চিত্রকার সহায় m¤^jnxb অবস্থায় পাকস্থলীর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে মধ্যে রয়েছে এট এভ্‌রাত সিলাহ (১৯৬৬), বেনিম আদিম কেরিম (১৯৬৭), বানা কুরসুম ইসলেমিজ (১৯৬৭), ছেয়্যিত হান (১৯৬৮), পিরে নুরি (১৯৬৮), বীর সিরকিন আদম (১৯৬৯), এসি কার্টলার (১৯৬৯), উমুত (১৯৭০), পিয়াদি ওসমান (১৯৭০), ক্যানলি হিদেফ (১৯৭০), ইয়ারিন সন গুনডুর (১৯৭১), ভারজানকিউলার (১৯৭১), উমুতসুজলার (১৯৭১), ক্যাকাকলার (১৯৭১), ইবরেত (১৯৭১), বাবা (১৯৭১), এসিআই (১৯৭১), এজিত (১৯৭২), য়েন্ডআইজ (১৯৭৪), আরকাদাস (১৯৭৪), জাভাল্লিলার (১৯৭৫), দুশমন (১৯৭৯), ইয়োল (১৯৮২), ডুভার (১৯৮৩)। বিপ্লবী এ চলচ্চিত্রকারের ছোট এই সাক্ষাতকারটি ১৯৮৩ সালে দ্য মিডল ইস্ট ম্যাগাজিনের জন্য নেয়া হয়। ইংরেজি এই সাক্ষাতকারটি ম্যাজিক লণ্ঠন এর পাঠকদের জন্য বাংলায় ভাষান্তর করা হলো।

প্রশ্ন : ফিরে আসি, আপনার নির্মিত দ্য হার্ড (সুরু) এবং দ্য ওয়ে (ইয়োল) চলচ্চিত্র দু’টি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

ইলমাজ গুনে : একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে জীবনের পুরো সময়কে, আমার চিন্তা-ভাবনাকে আমি একটু ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছি। নির্দ্বিধায় একথা বলতে পারি- আমি যা করতে চেয়েছি তা শতভাগ কখনো করতে পারি নি। এমনকি সেটা তাদের (কুর্দিদের) ধরন বা প্রত্যাশানুযায়ীও হয় নি। এ সমস্ত কাজের ক্ষেত্রে তাদের যে কর্তৃত্ব ছিল, তারা সেখানে আপসী মনোভাব দেখিয়েছে।

দি হার্ড চলচ্চিত্রটিতে কুর্দি জনগণের কাহিনী থাকা সত্ত্বেও এতে আমি কুর্দি ভাষা ব্যবহার করতে পারি নি। আমরা যদি কুর্দি ভাষায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতাম তাহলে এই চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সবাইকেই জেলে পাঠানো হতো। দ্য ওয়ে ক্ষেত্রে আমি দায়ারবাকির (Diyarbakir), উরফা (Urfa), সির্‌ত (Siirt) (তুরস্কের তিনটি প্রদেশের নাম এগুলো; দায়ারবাকির ও সির্‌ত তুরস্কের দক্ষিণের শহর। আর উরফা তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত) এলাকার দিকে জোর দিয়েছি। আমি এই সিনেমায় সঙ্গীতের ব্যবহার করে একটা কুর্দি পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারপরও চলচ্চিত্রটি ইউরোপে অপ্রত্যাশিত সাফল্য পায়। যদিও সব কুর্দিদের পক্ষে যায়- এমন কাজ করতে আমি এই সিনেমায় ব্যর্থ হয়েছি।

প্রশ্ন : নিজেকে একজন কুর্দি হিসেবে কখন চিহ্নিত করলেন?

ইলমাজ গুনে : অবশ্যই বলব, আমি একজন খাঁটি কুর্দি। আমার মা ছিলেন একজন কুর্দি এবং বাবা ছিলেন একজন জাজা কুর্দি (ইসলামি ধর্মাবলম্বী তুরস্কের একটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির নাম জাজা। দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় আনাতলিয়া প্রদেশে বসবাসকারী এ জাতিগোষ্ঠির লোকজন জাজাকি ভাষায় কথা বলে)। শৈশবের পুরোটা সময়ই আমি কুর্দি ও জাজা ভাষায় খুব ভালোভাবে কথা বলতে পারতাম। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমি কুর্দি ভাষায় কথা বলেছি। তারপর আমার পরিবার থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। ওই সময়ে আমি বলতে শুনতাম, ‘এখানে কোনো কুর্দি নেই; এখানে কোনো কুর্দিশ ভাষা নেই।’ কিন্তু আমি শুনতাম অন্য মানুষ কুর্দি ভাষায় কথা বলছে, গান গাইছে। আমি আরও দেখেছি, কুর্দিরা এখানে অনেক কঠিন সমস্যার মধ্যে জীবন ধারণ করেছে।

আমার বাবা সিভরেক থেকে এসেছিলেন। ১৬ বছর বয়সে আমি প্রথমবারের মত সিভরেক গিয়েছিলাম। সেখানে আমি সত্যিকারভাবেই অনুভব করি, আমি কে? সিভরেকে দুর্দশায় থাকা একটি ভূমিহীন পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। বাবা আমাকে বলতেন, ‘তুমি তোমার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন।’ যখন আমার বয়স ৩৪, তখন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মাতৃভূমি জিবরানের মুচ গোত্রে যাওয়ার। আর এই গোত্রে ঘটে যাওয়া একটি কাহিনীর ওপর নির্মিত হয়েছে দ্য হার্ড চলচ্চিত্রটি।

প্রশ্ন : আপনার চলচ্চিত্রের প্রধান প্রধান চরিত্রগুলোর সবাই যখন কুর্দি এবং চলচ্চিত্রের গল্পও কুর্দিস্তানকে নিয়ে। তাহলে কীভাবে নিজের দেশের বাইরে গিয়ে আপনি চলচ্চিত্রের যাবতীয় কাজ করবেন?

ইলমাজ গুনে : এখানে আমরা অনেক সাহসের সাথে বিপদ মোকাবেলা করেছিলাম। টানসেল কুর্তিজ নামে আমাদের শুধুমাত্র (দ্য হার্ড চলচ্চিত্রে যে বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল) একজন পেশাদার অভিনেতা ছিল। বাকিরা ছিল অপেশাদার। এমনকি, এদের মধ্যে অনেকেই আগে কখনো চলচ্চিত্রে অভিনয়ই করে নি। তুরস্ক থেকে পেশাদার শিল্পী আনা একদমই অসম্ভব ছিল, আবার যারা ইউরোপের তারাও আমার সাথে কাজ করতে আসতে ভয় পাচ্ছিল। এমনকি তারা আমার সাথে কথা বলতে পর্যন্তও অস্বীকৃতি জানাল।

প্রশ্ন : তুরস্কের অভিনেতারা ভেনিসে Palm d'Or পুরস্কার পাওয়া একজন পরিচালকের সাথে কাজ করল না?

ইলমাজ গুনে : যখন সবকিছু শান্ত থাকে তখন তারা জোর গলায় বিপ্লবী গান গায়; আর যখন দুঃসময় আসে তখন পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। আমার একজন তুর্কি চিত্রগ্রাহক ছিল। এত বড় একটা ইউনিটে টেকনিশিয়ানদের কেউ পেশাদার ছিল না; এমনকি একজনও না। আমার পরের চলচ্চিত্র জেল নিয়ে। তাই আমি আঁধার, দুঃখ এবং সবকিছুকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করি যেখানে দৃশ্যপট ও প্রকৃতির দরকার হয় না।

প্রশ্ন : আপনি কেন জেলকে বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করলেন?

ইলমাজ গুনে : এখানে দু’টি কারণ আছে। প্রথমত, তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিষয়বস্তু। দ্বিতীয়ত, আমি তখন পর্যন্ত ইউরোপে শুট করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

প্রশ্ন : পরবর্তী চলচ্চিত্রে কুর্দিস্তানের কোন বিষয়টি গুরুত্ব পাবে?

ইলমাজ গুনে : কুর্দি প্রশ্নটি খুব একটি জটিল বিষয়। আমি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জন্ম এবং পুনর্জন্ম নিয়ে জনগণের মধ্যে যে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের কাহিনী ধারণ করতে চাই। এখন এটি খুবই কঠিন একটি সমস্যা। তাদের কাউকে না কাউকে অবশ্যই বলতে হবে, কীভাবে কুর্দিরা বিভিন্ন ঘটনায় ও পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান থেকে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে সঠিক পন্থা বের করা খুবই কঠিন। বিজয়ের পুরো অংশই শুধু ইতিহাস নয়। পরাজয়, ভুল ও প্রবঞ্চনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ইতিহাস।

প্রশ্ন : আপনি বলেছিলেন, দেশের বাইরে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যান তখন কৌশলগত সমস্যার সম্মুখীন হন। এখন কীভাবে আপনি বলবেন, তুরস্কের সাথে আপনার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে? দেশের মানুষ ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক সত্ত্বেও কিন্তু আপনার চলচ্চিত্রে আপনার স্বদেশী কাউকে দেখা যায় না। কীভাবে আপনি এ সমস্যার সমাধান করবেন? আপনি কি স্থায়ীভাবে দেশের বাইরে চলে যাবেন?

ইলমাজ গুনে : নিশ্চিতভাবে; এই চলচ্চিত্রে যাতে আমাদের জনগণকে তুলে ধরা যায়, সেজন্য আমরা একটা পথ খুঁজে বের করব। কিন্তু এখনই আমি বলতে পারছি না, এটা কীভাবে করব। এরপর আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নে যাই, জেলের ওপর এই চলচ্চিত্র নির্মাণের পর কুর্দিস্তানকে নিয়ে কৃত্রিম পরিবেশে কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই না।

প্রশ্ন : তার মানে, ফ্রান্সেই কি আপনি আপনার জীবন কাটিয়ে দিবেন?

ইলমাজ গুনে : চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য একটা বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমি এখন ফ্রান্সে আছি। চলচ্চিত্রটির কাজ শুরু করা পর্যন্ত আমি এখানে থাকতে পারব। তারপর কী হবে আমি জানি না। আর এ মুহূর্তে আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো কথাও বলতে চাই না।

সূত্র : http://www.chris-kustschera.com/A/Yilmaz%20Guney.htm

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন