Magic Lanthon

               

মো. মশিহুর রহমান

প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

আলোতে ভাস্বর মিশুক স্যার

মো. মশিহুর রহমান


গত বছর ১৩ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটার দিকে বিভাগে বসে প্রথম খবরটি পাই। আমার একজন সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার, ফোন করে জানান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নেই। আঁতকে উঠে ‘কীভাবে’ জিজ্ঞাসা করতেই শুনি, সড়ক-দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তাকে ও মিশুক মুনীরসহ কয়েকজনকে। মুহূর্তে বুক খালি হয়ে যায়, দ্বিগুণ আঁতকে অনেকটা আর্তনাদ করে বলে উঠি আশফাক মুনীর স্যারও নেই। মিশুক মুনীর আমাদের আশফাক মুনীর স্যার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আশফাক মুনীর ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। গণমাধ্যম-পরিমণ্ডলে দেশ-বিদেশে মিশুক মুনীর নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি।

সত্যি বলতে কী, খবরটি আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছিল, আসলে বিশ্বাস না-করতে ইচ্ছা করছিল; তাই ক্রসচেকের জন্য মরিয়া হয়ে উঠি। অনলাইন পত্রিকাগুলো খুলে, বাসায় ফোন করে টিভির খবর দেখতে বলে- নিরুপায় বিশ্বাস করতে হয় সত্যি মিশুক স্যার আর নেই।

মিশুক স্যারকে যে খুব বেশিদিন শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি, তা নয়। ১৯৯২-৯৩ সালে স্যারকে যখন প্রথম দেখি তখন থেকেই জেনে এসছি তার বিশেষ আগ্রহ ও দক্ষতার ক্ষেত্র ক্যামেরা এবং এক্ষেত্রে তখনই তিনি দেশের অন্যতম। কেতাদুরস্ত, খুব নিয়মিত চিরাচরিত শিক্ষকমূর্তি মিশুক স্যারের মাঝে দেখি নি বটে, কিন্তু তার চৌকস উপস্থিতি ও উপস্থাপন, বন্ধুসুলভ চলাফেরা- অন্যরকম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কেড়ে নিয়েছিল ঠিকই। মনে আছে, সম্মান শেষ বর্ষে আমাদেরকে তিনটি গ্রুপে ভাগ করে কয়েকজন শিক্ষক সম্পাদনা শেখাতেন। স্যার ছিলেন আমাদের গ্রুপের শিক্ষক। প্রথম ক’দিন স্যার ক্লাসে এলেন না। ক্লাস শুরু না-করার সঙ্গে অন্য গ্রুপের এগিয়ে যাওয়ার ঈর্ষা যুক্ত হয়ে আমরা একটু বিরক্ত হয়ে পড়ি। মনে পড়ে পরে স্যারের সেই ক্লাসগুলো, মনে পড়ে আধা-ফরমাল, ক্যাজুয়াল পোশাকে ইংরেজি-বাংলায় মেশানো অসাধারণ উপস্থাপন। কতগুলো ইংরেজি শব্দ আজও  মনে পড়ে স্যারের কাছ থেকে শেখা।

ক্লাস-লেকচার-পরীক্ষা-খাতাদেখা- শিক্ষকের অতি নিয়মিত এ-কাজগুলো তাকে হয়ত তেমন টানতো না। টানবেই বা কেন, স্কুলের ছাত্রাবস্থায়ই তো তিনি নাকি ক্লাসের পড়ালেখার চাইতে ছবি তুলতেই আগ্রহী ছিলেন বেশি। মিতি আপা (কুররাতুল আইন তাহমিনা- মিশুক স্যারের কাজিন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক, বর্তমানে সাংবাদিক) একটি লেখায় বলেছেন- শিক্ষকদের মুখে মিশুক স্যারের প্রশংসা তারা শুনলেও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় তার নাকি ফাঁকিবাজি ছিল কিংবদন্তিতুল্য। স্যারের দেখাদেখি তিনিও (মিতি আপা) নাকি সাংবাদিকতা পড়তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এই ভেবে যে, মিশুক যখন পড়ছে ক্লাসে আটকে পড়ার চান্স এখানে নিশ্চয় নেই। সেই মিশুক স্যারই ১৯৭৯ সালে ওই বিভাগের স্নাতক সম্মান প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হয়ে ভাল ফল করেছেন, শিক্ষকও হয়েছিলেন।

১৯৮০ সালেই একটি শিক্ষাকার্যক্রমে কানাডায় একটি জাদুঘরে শিশুশিক্ষা বিভাগে চিত্রগ্রাহক ও সহকারীর কাজ করে আসেন স্যার। আর সেই সূত্রেই জাতীয় জাদুঘরের অডিও ভিজ্যুয়াল শাখা গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পান ১৯৮২ সালে, ছাত্রাবস্থায়ই। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সাত বছর সেখানে কাজ করেন অডিও ভিজ্যুয়াল কর্মকর্তা হিসেবে। আর এর পাশাপাশি ক্যামেরা হাতে চালিয়ে যান তথ্যচিত্র, টেলিফিল্ম, টিভি-নাটক নির্মাণের কাজ। ১৯৮৬ সালে জার্মানির ওবারহাউজেন আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসবে ঢাকা টোকাই নামের বাংলাদেশের একটি ছবি পুরস্কার জিতে। মিশুক মুনীর ছিলেন সেই ছবির সহকারী পরিচালক ও চিত্রগ্রাহক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার আগেই মিশুক মুনীর নিজেকে চিনিয়েছেন অন্যজগতের মানুষ হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যতদিন কাজ করেছেন বিভাগের মিডিয়া সেন্টার, চিত্র ও সম্প্রচার-সাংবাদিকতা, ভিডিও যোগাযোগ সংক্রান্ত পঠনপাঠন ও পরিকল্পনা তৈরিতে কাজ করেছেন নিরলসভাবে।

তারপরও অন্যজগতের মানুষ মিশুক মুনীরের বিশ্ববিদ্যালয় ভাল লাগল না। ক্যামেরা-হাতে কাজ করার তাড়নায়, সাংবাদিকতায় পুরোদস্তুর সম্পৃক্ত হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এরপর চলে যান বিলেতে। ১৯৯৯ সালে সেখানকার বিভিন্ন সুবিধা ছেড়ে তিনি দেশে ফেরেন; একুশে টেলিভিশন এর সূচনালগ্নে দায়িত্ব নেন হেড অব নিউজ অপারেশনস্‌-এর। বাংলাদেশে সম্প্রচার সাংবাদিকতার সনাতন চেহারা পাল্টে দিয়ে নিয়ে আসেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তার মেধা-মনন কাজে লাগিয়ে জগদ্বিখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং এর সঙ্গে একুশে টেলিভিশন এ গড়ে তোলেন আধুনিক এক সংবাদ-দল, এই চ্যানেলের খবরে এনে দেন গগণচুম্বী জনপ্রিয়তা। আমরাও তখন এই জনপ্রিয়তায় বুক ফুলাই, ভাগ বসাই- আমার শিক্ষকের হাত-মেধা-পরিকল্পনা এখানে আছে যে!

মিশুক মুনীর ২০০১ সাল পর্যন্ত কাজ করেন একুশে টেলিভিশন এ। এরপর ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কানাডার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্স ক্যামেরাপারসন ও প্রযোজক হিসেবে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে তার কাজের ক্ষেত্র তাকলাগানো। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ডব্লিউটিএন, এআরডিআই, চ্যানেল ফোর, সিবিসি, ডিসকভারি হেলথ্‌-এর হয়ে কাজ করেছেন তিনি। ছুটে বেড়িয়েছেন ভারত, আফগানিস্তান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, সুদানে। কানাডার রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্কের-এর হেড অব ব্রডকাস্ট অপারেশনস্‌ হিসেবে দীর্ঘ আট বছর কাজ করেছেন, বিকল্প সাংবাদিকতাকে এগিয়ে নিয়েছেন সফলতার সঙ্গে।

আমাদের দেশে সম্প্রচার সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত, সবসময় ক্যামেরার পিছনে কাজ করা মিশুক মুনীর ক্যামেরা এড়িয়ে চলেছেন সব সময়। সবরকম সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রচারে আসেন নি কখনো। নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। কানাডায় সব সুযোগ-সুবিধা পায়ে ফেলে সর্বশেষ দেশে ফিরে ২০১০ সালে যোগ দিয়েছিলেন এ-দেশের নিউজ চ্যানেল এটিএন নিউজ এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে। এ-দেশের সম্প্রচার সাংবাদিকতায় প্রযুক্তি আর মেধার সমন্বয় করতে চেয়েছিলেন তিনি, চেয়েছিলেন সংবাদ ও সংবাদ মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে। তাইতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হয়েও ক্যামেরা হাতে ছুটে যেতেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্পটে। লিবিয়ায় সাম্প্রতিক সংকটের সময় সেদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের অবস্থা তুলে ধরতে নিজেই ছুটে যান সেখানে।

শুধু কি সাংবাদিকতা? চলচ্চিত্রে চিত্রগ্রাহক হিসেবেও তিনি দেখিয়েছেন অসামান্য দক্ষতা। তারেক মাসুদ পরিচালিত রানওয়ে ছবির প্রধান চিত্রগ্রাহক ছিলেন মিশুক মুনীর। এছাড়া তিনি আদম সুরত, রিটার্ন টু কান্দাহার, ওয়ার্ডস অব ফ্রিডম ইত্যাদি তথ্যচিত্রগুলোতেও কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন একাডেমি অব কানাডিয়ান সিনেমা এ্যান্ড টেলিভিশন এবং কানাডিয়ান ইনডিপেনডেন্ট ক্যামেরাম্যান অ্যাসোসিয়েশন-এর সদস্য এবং কানাডিয়ান সোসাইটি অব সিনেমাটোগ্রাফির সহযোগী সদস্য। তারেক মাসুদের সর্বশেষ কাগজের ফুল চলচ্চিত্রের চিত্রগ্রহণও তার করার কথা ছিল। এই চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখে ফেরার পথে চলে গেলেন তিনি।

আসলে কি চলে গেলেন, নাকি আমরা রাখতে পারলাম না তাকে? দুর্ভাগ্য আমাদের, দুর্ভাগ্য দেশের, সাংবাদিকতার। দেশ-বিদেশে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা, চরম ঐকান্তিকতা নিয়ে অতি পরিপক্ক পরিপূর্ণ একজন মানুষ যখন সত্যিকার অর্থে দেশের জন্য চূড়ান্তভাবে নিবেদিত হলেন, তখনই আমরা হারালাম তাকে। তার আর কিছু নেয়ার ছিল না, ছিল কেবলই দেয়ার।

কতদিন স্যারের সঙ্গে দেখা হয় নি, কথা হয় নি। অথচ হতে পারত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই, স্যার চলে যাবার ক’দিন আগে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিশ বছর পূর্তিউৎসব আয়োজনের প্রস্তুতিমূলক কিছু কাজ সারতে ঢাকায় গিয়েছিলাম সে সময়। এই কাজের অংশ হিসেবে এটিএন নিউজে যাই মুন্নী দি’র (মুন্নী সাহা) কাছে। স্যার তখন ছিলেন না। ওখানে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে, মুন্নী দি’র সঙ্গে কথা বলে বের হব তখন শুনলাম স্যার এসেছেন। অনেক কষ্টে স্যারের সঙ্গে সে যাত্রায় দেখা করার ইচ্ছা সংবরণ করতে হলো। কারণ, তখন এটিএন বাংলায় আমার জন্য অপেক্ষা করছেন দুইজন সিনিয়র সাংবাদিক। আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা, যেতে হবে আগে সেখানেই। আজ কেবলই অনুশোচনায় ভুগি- ইস্‌! স্যারের সঙ্গে যদি সেদিন একটু দেখা করতাম। না-হয় এটিএন বাংলায় যেতে একটু বিলম্ব হতো, স্যারের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা তো হতো!

মিশুক মুনীরের ধ্যানজ্ঞান ছিল কাজ; ক্যামেরার কাজ, ক্যামেরা নিয়ে কাজ। আলো নিয়ে কাজ করতেন তিনি, আলোকরশ্মিকে ব্যবহার করতেন ক্যামেরা দিয়ে। সেই কাজ দিয়ে আলো ছড়িয়েছেন তিনি, ছড়িয়েছেন শিক্ষার আলোও। তার শিক্ষায় আলোকিত হয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী- বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষক হিসেবে তার পাঠ নিয়ে অনেকে আজ কর্ম ও ব্যক্তিজীবনে দ্যূতিময়। সাংবাদিক মিশুক মুনীরের সাহচার্য-শিক্ষা-সহযোগিতা-পরামর্শে সমৃদ্ধ, বিশেষভাবে, দেশের সম্প্রচার-সাংবাদিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান নিজেকে চিনিয়েছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাইতো তাদেরই কেউ কেউ মিশুক মুনীরকে আখ্যা দেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে।

মিশুক স্যার চলে যাননি, মিশে আছেন আলোতে। তার ছড়ানো আলোর মধ্যেই তিনি রয়েছেন, থাকবেন চিরঞ্জীব চিরভাস্বর হয়ে; চিরশ্রদ্ধেয়, চিরস্মরণীয় হয়ে।

লেখক : মো. মশিহুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ  সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান। বর্তমানে তিনি একই বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন

mashihurrahman@yahoo.com

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন