Magic Lanthon

               

কাজী মামুন হায়দার

প্রকাশিত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

নক্ষত্রের পতন ও দুর্ভাগা চলচ্চিত্র

কাজী মামুন হায়দার


এই সময়, এই বাস্তবতায়; এ ধরনের শিরোনামের বাইরে আর কিছু দেয়া যায় কিনা আমার জানা নেই। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, এই পরিস্থিতিতে তার চলে যাওয়ার ক্ষতি ব্যাখ্যা করাও অতিকথন। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সব বয়সী মানুষের এক ধরনের আশ্রয়, ভরসার জায়গাটা হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেল। স্বপ্নগুলো হয়ত স্বপ্ন থেকে গেল, ডানা মেলে বাংলার মুখ, বিশ্ব চলচ্চিত্রের মুখ উজ্জ্বল করতে পারল না। হয়ত তার অনেক আলোচনা-সমালোচনা ছিল; কিন্তু এ কথাও ঠিক খোদ সমালোচকরাও তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। আসলে এর বাইরে যাওয়ারও উপায় ছিল না। আপন মহিমায় তিনি নিজেকে সবার থেকে যে উচ্চে তুলেছিলেন, সেটা শ্রদ্ধায় নত হওয়ার মতো অবস্থানই। তারেক মাসুদের কথা বলছি। আসলে তাকে নিয়ে এ ধরনের আরও অনেক কথা বলতে মনে কেন জানি একধরনের ভাল লাগা কাজ করে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়; এ ধরনের মানুষগুলো কেন জানি ক্ষণজন্মা হয়। তারেক মাসুদ যেদিন মারা গেলেন সেদিন থেকে বারবার কেবল এই কথাটাই মনে হচ্ছিল। তারেক মাসুদের সঙ্গে আরও দু’জন মানুষের নাম মনে ভাসছিল। ভাবছিলাম প্রকৃতি কেমন জানি রূঢ় আচরণ করে বাংলাদেশের মানুষের ওপর। কেমন জানি স্বপ্নগুলো দেখানো হয়, কেবল স্বপ্ন দেখানোর জন্যই, বাস্তবায়নের জন্য নয়।

দেখুন, ১৯৭২ এর কথা। সদ্য স্বাধীন দেশ। অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটাতে চলচ্চিত্রেরও যখন ভিত্তির ইট গাঁথানোর কথা, সেই সময় মূল যে ‘মিস্ত্রি’ তিনিই কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। জহির রায়হানের কথা বলছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ওই একটি লোকই হয়ত পারত, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের আসনে বসাতে। কিন্তু অগ্রজকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়ে গেলেন। এতিম করে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রকে। ওই ক্ষতি আমরা আর পোষাতে পারলাম না। তিনি বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসটা হয়ত অন্যভাবে লেখা হতে পারত। সেটা আর হলো না।

কিন্তু প্রকৃতিতো আর কোনো জায়গায় ফাঁকা রাখেন না। সময়ের তাগিদে, সংকটে কেউ না কেউ বেরিয়ে আসে। অনেকের মধ্যে অনন্য হয়ে ওঠে। স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গুটি-গুটি পায়ে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির যাত্রা শুরু হতে লাগল। তখন চলচ্চিত্রের আধেয়ের একটা অন্যতম বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। বিশাল আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক সময় তা ঠুনকো হয়ে যায়। হয়ত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগ একটু বেশি ছিল, আর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা থাকারও কথা। সেই আবেগ, সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রগুলো হয়ে উঠল যুদ্ধ, নারী নির্যাতন আর ধর্ষণের ছবি। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় চলচ্চিত্র দেশ গঠনে যেমন ভূমিকা রেখেছিল আমাদের চলচ্চিত্র তা করতে ব্যর্থ হলো। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে কেউ মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারছিলেন না।

এইরকম একটা সময়ে কাণ্ডারি হয়ে এলেন একজন, তিনি আলমগীর কবির। ৭০’র দশকের শুরুতে তিনি নির্মাণ করলেন ভিন্ন ধারার, ভিন্ন গল্পের মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩) দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র আন্দোলন করা এই মানুষটি নিজ গুণেই হয়ে উঠলেন অনন্য। এরপর একে একে দিয়েছেন অনেকগুলো ছবি। একপর্যায়ে হয়ে ওঠেন বাংলা সিনেমার কাণ্ডারি। ৮০’র দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে তিনি যখন নিয়ন্ত্রণ করছেন আপন মহিমায়, তার দিকে তাকিয়ে আছে বাংলার লাখো চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক; ঠিক তখন শুটিং লোকেশন থেকে ফেরার পথে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে ফেরিতে ওঠার আগমুহূর্তে পিছনের গাড়ির ধাক্কায় নদীতে পড়ে যান তিনি। পরে লাশ উদ্ধার করা হয়। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষ ও দেশের লাখো চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকের জন্য এই শোক সহ্য করা ছিল ভয়ংকর রকমের কষ্টের।

দিন থেমে থাকে নি, থেমে থাকে না। সময় পেরিয়ে যায়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র একে একে পার হতে থাকে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। তবে বেশিরভাগ ঘাতেরই প্রতিঘাত করতে পারছিল এই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি। তাই বছরের একটা-দুটো হিট চলচ্চিত্র, দু-একটা ‘আর্ট-ফিল্ম’কে সঙ্গী করে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে চলতে হচ্ছিল ধিকিধিকি করে।

’৭১ পরবর্তী যেকোনো সংকটের সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের সাহস দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে। অনেক সময় দিয়েছে সঠিক পথে চলার নির্দেশনা।’৭১ এ ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সাথে থেকে শুটিং করা মার্কিন নাগরিক লিয়ার লেভিনের বিরল-সব ফুটেজ নিয়ে তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ তৈরি করলেন মুক্তির গান। এমন একটা ইতিহাস পেয়ে বাংলার মানুষ যেন নড়েচড়ে বসল। গতানুগতিক সিনেমার মতো না হওয়ায় মাসুদ নিজে প্রজেক্টর ঘাড়ে নিয়ে তা প্রদর্শন করে বেরিয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বাংলার মানুষকে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন চেতনা। এরপর কিছুদিন বিরতিতে তারেক নির্মাণ করলেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০০ চলচ্চিত্রের একটি মাটির ময়না। 

শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে দিল সেই চলচ্চিত্র। আমরা গর্বিত হলাম, আশায় বুক বাঁধলাম; ভাল সময় বুঝি এল। এরপর অন্তর্যাত্রা। চলচ্চিত্রটির মুক্তি ৩৫ মিলিমিটারে হলেও ডিজিটাল ফরমেটের এই চলচ্চিত্র দেখে মানুষ বুঝল কাঁপা, ঘোলা, রোদে ফেটে যাওয়া চলচ্চিত্রের দিন শেষ। তারেক বেঁচে থাকলে হয়ত সেটা হতোও। চলচ্চিত্রে আরও কত বেশি উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে তারেকের ছিল কতই না চিন্তা। যেকোনো বয়সী চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ যখনই তারেকের কাছে গেছে তাকে তিনি দ্রুত আপন করে সেই স্বপ্নের কথা বলতেন। বিশেষ করে তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীদের জন্য তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো এক আশ্রয়স্থল। তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীরা যখন যেভাবে তারেকের কাছে গেছে, তিনি তাদের তার সর্বোচ্চটা দিয়ে তাদের সহযোগিতা দিয়েছেন। নানা কাজ করেছেন তরুণদের নিয়ে।

বৈশ্বিক ও দেশীয় পট-পরিবর্তন। মানুষের নানা জিজ্ঞাসা, দেশে দেশে জঙ্গিবাদী ডিসকোর্সের অসহনীয় চাপ- এসব কিছুকে মাথায় রেখে এরপর এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে তারেক নির্মাণ করলেন তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র রানওয়ে। চলচ্চিত্রের মন্দা পরিবেশ, চারদিকে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধের মিছিল- এমন একটা পরিস্থিতিতে শিল্পের তাড়না থেকে তারেক আবার কাঁধে তুলে নিলেন প্রজেক্টর। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষকে তিনি রানওয়ে দেখালেন। একই সঙ্গে চলচ্চিত্র শিল্প বাঁচানোর তাগিদ থেকে করলেন মতবিনিময়, মুক্ত আলোচনা; কথা বললেন শ্রমিক থেকে সমাজের নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে। কাজও হলো; রানওয়ে নিয়ে সারা দেশে কেমন যেন একটা সাড়া পড়ে গেল।

তারেক মাসুদ সবাইকে বলতে থাকলেন চলচ্চিত্রের এ অবস্থার উন্নতি হতে বাধ্য। ভাল দিন আসছে। যে দেশে এত দর্শক, সেই দেশে কেন চলচ্চিত্র ব্যবসা করবে না? সিনেমার ফেরিওয়ালা নাম নিয়ে তারেক নিজে এগোতে থাকলেন। সঙ্গে আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। ওই যে আগেই বলেছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কী যেন আছে, ভাল কিছু বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। যেমন পারে নি, জহিরকে, আলমগীর কবিরকে। তেমনি ধরে রাখতে পারল না তারেককে; আমাদের সবার প্রিয় তারেক মাসুদকে।

তারেক মাসুদ আমাদের দিয়েছেন অনেক। আমরা তাকে কিছুই দিতে পারি নি। বহু কষ্টে তারেক বানাতেন একেকটি চলচ্চিত্র। নিজের সিনেমা দেখানোর জন্য এত বড় মাপের একজন চলচ্চিত্রকার প্রজেক্টর কাঁধে নিয়ে ঘুরতেন, আমরা তাকে প্রেক্ষাগৃহ দিতে পারি নি। বিনা টাকায় তারেক বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি টেলিভিশন বিটিভিতে দেখাতে চেয়েছিলেন তার প্রথম চলচ্চিত্র আদম সুরত, আমরা দেখাতে পারি নি। শেষ পর্যন্ত পারি নি তাকে ধরে রাখতে।

দেশপ্রেমিক তারেক, দেশের জন্য কী করেন নি! আগেই বলেছি লিয়ার লেভিনের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষকে এনে দিয়েছিলেন স্বর্ণখনি। অন্য সব বাদ দিলে কেবল ওই একটা কাজের জন্য তারেক-ক্যাথরিন বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের সমান।

তারেক ভাই মারা যাওয়ার সময় থেকে আজ পর্যন্ত একটা বিষয় বারবার আমার মাথায় কেন জানি ঘুরপাক খেয়েছে, এখনো খাচ্ছে। সেটাই আমার সর্বশেষ কথা। আমি ভাবি, দুর্ঘটনার পর দু-তিন ঘণ্টা রাস্তায় পড়েছিল তারেক, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃতদেহ। এই সময়ের মধ্যে নিশ্চয় হাজার হাজার মানুষ ওই পথ দিয়ে, ওই মৃতদেহগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে, গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করেছে। ছিল স্থানীয় প্রশাসন; তাদের কেউ কী একবারের জন্যও জানত ঘিওরের ওই রাস্তায়, লাশের স্তুপের মধ্যে বাংলাদেশের কত গুরুত্বপূর্ণ দু’জন ব্যক্তি অবহেলায় পড়ে আছেন। হয়ত জানত, হয়ত জানত না। তাতে তারেক কিংবা মিশুকদের কিছুই এসে যায় না। কিন্তু এ দেশটির কিন্তু অনেক কিছু এসে যায়। গুণীরা বলেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেদেশে নাকি গুণীরা জন্মায় না।

আর এ কারণেই হয়ত অভাগা দেশটিতে জন্মেও অসময়ে অভিমান করে চলে যেতে হয় মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান ও তাদের উত্তরসূরী তারেক-মিশুককে। কিন্তু এই অস্থির সময়ে আমরা যারা বেঁচে আছি, আমরা যারা আমজনতা; তারা শুধু এটুকু বলতে চাই, তোমাদের মৃত্যু আর কাউকে না করুক, আমাদের অনেক বেশি অসহায় করে দেয়।

লেখক : কাজী মামুন হায়দার রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের গণযোগাযোগ  সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান

kmhaiderru@yahoo.com


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন