Magic Lanthon

               

ইমরান হোসেন মিলন

প্রকাশিত ০৪ অক্টোবর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

সেলুলয়েডে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

‘সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে : চোখের দেখায় তা তো মিথ্যা নয়!’

ইমরান হোসেন মিলন


যা দেখি তা তো মিথ্যা নয়। কারণ, যা ঘটে তার অংশই তো দেখানো হয়; গণমাধ্যমের কথা বোঝাচ্ছি। গণমাধ্যম ‘অতি-প্রত্যক্ষ’ ব্যাপারই তুলে ধরে। যেমন, হরতালের যে-সহিংসতা আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখি তা তো হলিউডের কোনো চলচ্চিত্রের মতো অ্যানিমেশন কিংবা সফটওয়্যারের কাজ নয়। বাস্তবচিত্রই; ‘অতি-প্রত্যক্ষ’ ঘটনাই। কিন্তু ‘অতি-প্রত্যক্ষ’ ঘটনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা হলো এর বিরোধিতা করা খুবই কঠিন, ‘অতি-প্রত্যক্ষ’র ভিতরে গলদ থাকার পরও। ‘যেমন হয়েছিল গ্যালিলিওর ক্ষেত্রে। সব্বাই চোখের উপর দেখছে যে, সূর্যটা পুব দিকে দিয়ে উঠে উপর দিয়ে ঘুরে পশ্চিমে চলে যায় : অথচ উনি বললেন অন্য কথা। সাধারণ মানুষের ধারণায় আজও বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাঁরা আজও ঐরকমই দেখেন।’ আজকাল এই ‘অতি-প্রত্যক্ষ’ ব্যাপার চলছে সবখানে। তবে আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস গণমাধ্যমে এই হার সবচেয়ে বেশি। কারণ, গণমাধ্যমে উপস্থিত ঘটনাগুলোর প্রায় সবই ‘অতি-প্রত্যক্ষ’। কিন্তু এ-কথাও বলে নেওয়া ভালো, গণমাধ্যমে ‘অতি-প্রত্যক্ষ’র বাইরে যে-সত্য লুকায়িত থাকে তা ‘পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরে’ এ-রকম পুরো বিপরীত মেরুর সত্য নয়। এবং তা উপস্থাপন করলে গ্যালিলিওর মতো প্রাণও দিতে হবে না। এ-সত্য প্রায় ক্ষেত্রেই ‘অতি প্রত্যক্ষ’ ঘটনার জন্মদাতা হিসেবে অগোচরে থেকে যায়। যা চেনা সমীচীন হলেও আমরা চিনতে পারি না; গণমাধ্যমে তার জোরালো উপস্থাপনও দেখি না। আজকের আলোচনায় এ-বিষয়ই খোঁজার চেষ্টা করবো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রে। যার একটি তানভীর মোকাম্মেলের চিত্রা নদীর পারে এবং আরেকটি দীপা মেহতার আর্থ। আলোচনায় আমি যতোটা না এ-দুটি চলচ্চিত্রে থাকবো, তার চেয়েও বেশি করে থাকার চেষ্টা করবো দাঙ্গার ভিতরে। কারণ, দাঙ্গা সংক্রান্ত চলচ্চিত্রে কী দেখানো হয়, তা বেশিরভাগ দর্শকই ওয়াকিবহাল। তাই আলোচনার চেষ্টা থাকবে এর বাইরে, দাঙ্গার যদি সম্প্রসারিত কোনো রূপ থাকে-সেটি খুঁজে বের করা।


সর্বপ্রকারের পুঁজিপাটা মালিকানায় রয়েছে এই বোধ-‘ইহা আমার জ্ঞান’, এ জ্ঞান আমি অর্জন করেছি; অতএব এটি আমার। মানবসমাজে এই বোধের উদ্ভব না হলে, কোনও প্রকার মালিকানা, পুঁজি, পণ্য কোনও কিছুরই জন্ম হত না। শ্রমবিভাজন হত না, দেশে দেশে জাতিতে-জাতিতে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ত না।

 

‘আমিত্ব’ দিয়ে নতুনের শুরু

দাঙ্গা নিয়ে বিতর্ক ও আপেক্ষিকতার বাইরে গিয়ে যেটি বলা যায়, এটি মানুষসংক্রান্ত, মানুষে-মানুষে সংক্রান্ত একটি ব্যাপার। তাই দাঙ্গা নিয়ে কথা বলা মানে মানুষ নিয়ে কথা বলা। আর মানুষ নিয়ে কথা বলতে গেলে এর শুরু না দেখলে হয় না। কিন্তু আমার মতো আনাড়ি লেখকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেকায়দা হলো মানুষের শুরু নিয়ে নতুন করে কিছু বলা। এ-সংক্রান্ত যে-কয়েকটি বই পড়েছি সেখানেও সমার্থক বক্তব্যই বেশি পেয়েছি। ডারউইন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নেহেরু, রেবতী বর্মণ, মরগান, বার্ট্রান্ড রাসেল কিংবা এঙ্গেলস্-এর লেখাগুলোতে অমিলের চেয়ে মিলই বেশি। এসব বইয়ে দেখতে পাই-মানুষ প্রথমে শিকার করে জীবন চালাতো। যে-শিকারের কৌশল বুদ্ধি আর যন্ত্রের বিকাশে দিনে দিনে উন্নত হয়। এভাবেই মানুষ এক সময় সভ্যতা গড়ে তোলে। যদিও অসভ্যতা এখন পর্যন্ত তার পিছু ছাড়েনি। নাকি মানুষই তাকে ছাড়েনি, কে জানে! যাই হোক সমাজে নতুন করে সৃষ্ট সবকিছুই যখন আস্তে আস্তে সমাজের সঙ্গে যোগ হয়েছে তখন দাঙ্গাও কোনো এক সময়েই সৃষ্ট। যদিও সেই সৃষ্টির জন্ম তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে আমারও বিশ্বাস, এর সঙ্গে আমি বা আমিত্বর একটা সম্পর্ক রয়েছে। যে আমিত্বর রূপ হতে পারে, ব্যক্তির একক আমিত্ব কিংবা জাতি বা গোষ্ঠীর সমষ্টিগত আমিত্ব। এ-বিশ্বাস আমার কলিম খানের একটি লেখা পড়ে হয়েছে। যে-লেখায় এ-প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন, সর্বপ্রকারের পুঁজিপাটা মালিকানায় রয়েছে এই বোধ-ইহা আমার জ্ঞান, এ জ্ঞান আমি অর্জন করেছি; অতএব এটি আমার। মানবসমাজে এই বোধের উদ্ভব না হলে, কোনও প্রকার মালিকানা, পুঁজি, পণ্য কোনও কিছুরই জন্ম হত না। শ্রমবিভাজন হত না, দেশে দেশে জাতিতে-জাতিতে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ত না। এই শেষে যে-বিভক্তির কথা বলা হলো সেটিই সম্ভবত দাঙ্গার প্রধান কারণ। এই আলোচনায় কিংবা আজতক দাঙ্গা শব্দের যে-অর্থ দাঁড়িয়েছে তার প্রধান উপাদান সহিংসতা ও হিংস্রতা। এখন আমিত্ব মানেই কি হিংস্রতা, সহিংসতা? না, তা-না। তবে আমিত্বর সঙ্গে স্বার্থের, স্বার্থের সঙ্গে দাঙ্গার ও দাঙ্গার সঙ্গে সহিংসতা-হিংস্রতার একটি পারস্পরিক সম্পর্ক বিদ্যমান।

বিষয়টি খুলে বললে বলতে হয়, মানুষগুলো শিকার ছেড়ে, বসবাসের গুহা ছেড়ে বেরিয়ে এসে গড়ে তুলেছে সভ্য সমাজ। কিন্তু এই সমাজে এসে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। বন্য অবস্থায় আয়ত্ব করা শিকার কৌশলগুলো তারা প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে থাকে অন্যদের ওপর। এই অন্যরাও ছিলো মানুষ। বার্ট্রান্ড রাসেল বিষয়টি গুছিয়ে বলেছেন এভাবে-পুরোনো সেই বিপদগুলো পার হয়ে আসার পর নিজের ওইসব অভ্যাস আর আবেগগুলো নিয়ে কী করার ছিল তার? ভেবেচিন্তে একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছিল সে, তবে দুর্ভাগ্যবশত সেই সমাধানটা সুখকর ছিল না। যে বৈরিতা আর সন্দেহকে সে এতদিন পরিচালিত করত বাঘ-সিংহের বিরুদ্ধে, সেই বৈরিতা আর সন্দেহকে এবার সে পরিচালিত করল অন্য মানুষদের বিরুদ্ধে। না, সবার বিরুদ্ধে নয়, কারণ যেসব দক্ষতার সাহায্যে সে টিকে থাকতে পেরেছিল তার অনেকগুলোর জন্যই প্রয়োজন হতো সামাজিক সহযোগিতা। সেই সহযোগিতার বৃত্তের বাইরে থাকত যারা, তাদের বিরুদ্ধেই নিজের সন্দেহ আর বৈরিতা পরিচালিত করল মানুষ। আর সেই সময় থেকেই মানুষের মধ্যে তৈরি হয় হানাহানির মানসিকতা, নিজেকে সবার থেকে আলাদা ভাবার মানসিকতা।

 

দাঙ্গা আর সাম্প্র্রদায়িকতা একই?

সেলুলয়েডে দাঙ্গার উপস্থাপন নিয়ে আলাপ তুলবার আগে দাঙ্গা শব্দের উৎপত্তি নিয়ে একটু বলার প্রয়োজনবোধ করছি। দাঙ্গা শব্দটি বাংলা ভাষায় প্রথম দিকে ছিলো না। শব্দটি ফারসি অপভ্রংশ জঙ্গ থেকে এসেছে। মোগল আমলে যেসব মোগল সৈন্য শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন তাদেরকে বলা হতো জঙ্গ। কিন্তু সেই মোগলদের বিরুদ্ধে শিবাজী যে-যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করতেন তাকে আবার শিবাজী বলতেন দঙ্গ। এক সময়ের সেই শিবাজীর দেওয়া নাম দঙ্গ থেকে কালক্রমে এসে তা হয় দাঙ্গা। যা এখন বাংলা ভাষায় স্থায়ী আসন গেড়েছে।

বাংলায় বিভিন্ন সময় আগমন ঘটেছে পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজদের মতো জাতির। তারা এ-অঞ্চলে আসার পূর্বেও কিন্তু এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ বা অন্যান্য ধর্মের মানুষের মধ্যে মারামারি বা খুনের ঘটনা যে-ঘটেনি এমন নয়। কিন্তু সেগুলোকে কখনই দাঙ্গা বলা হয়নি। এমনকি যখন ইংরেজি শব্দ রায়ট (riot) থেকে বাংলা অর্থ করা হয়, তখনও কিন্তু তা ছিলো ইতিবাচক। ১৭১৪ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে ইংরেজি ভাষায় রায়ট শব্দটির অর্থ ছিল আনন্দোৎসব, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা, অবাধ অপব্যয়, নরনারীর যৌন হট্টগোল ইত্যাদি। ইংল্যান্ডের রাজার বিরুদ্ধে জ্যাকোবাইট আন্দোলন দমন করিবার জন্য ১৭১৪ সনে রায়ট অ্যাক্ট পাশ হইবার পর রায়ট শব্দটির অর্থে ঋণাত্মক পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। এ-থেকে বোঝা যায়, এটি আসলে ইংরেজদের তৈরি একটি অভিধা। যার অর্থ পরিবর্তন হয়ে থাকবে, শুধুই তাদের স্বার্থের কারণে। 

একই অবস্থা আমরা দেখি সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি নিয়ে। সম্প্রদায় থেকে সাম্প্রদায়িক কথাটির উদ্ভব। প্রথম অবস্থায় সাম্প্রদায়িক কথাটিও ব্যবহার করা হতো ইতিবাচক অর্থে। সম্প্রদায় বলতে এক সমষ্টিকে বোঝায় যারা জাতি, বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা, জীবিকা বা ধর্মের ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে নৈকট্য অনুভব করে। যেমন আমরা বলি ইহুদি সম্প্রদায়, শিখ সম্প্রদায়, বৈষ্ণব সম্প্রদায়, শিক্ষক সম্প্রদায়...প্রত্যেক সম্প্রদায়ের কিছু নিজস্ব চরিত্র, চিন্তা ও চেতনা আছে। বিশেষ একটি স্বার্থ তাদের মধ্যে ঐক্যের ধারণা সৃষ্টি করে। এই স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনেই তারা সংগঠিত হয়। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট মনুষ্য গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জন করার মানসিকতা নিয়ে সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে থাকে। আর এই সম্প্রদায় সম্পর্কিত সবকিছুকেই সাম্প্রদায়িক বলা হতো। কিন্তু বর্তমানে এসে সাম্প্রদায়িক পদটিকে কেবল নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক শব্দটা আমরা এখন অনেকটাই মৌলবাদী অর্থে ব্যবহার করে থাকি। যার মধ্যে কল্পনা করি দাঙ্গা, সহিংসা, হিংস্রতা।

 

চলচ্চিত্রে দাঙ্গা, দাঙ্গার চলচ্চিত্র

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিষয়ক বেশিরভাগ চলচ্চিত্রই আমার কাছে অতি-প্রত্যক্ষ ঘটনার উপস্থাপন মনে হয়েছে মাত্র! হিসেব মতে, এসব চলচ্চিত্রে উঠে আসা দরকার ছিলো-Ñকেনো, কাদের কারণে, কাদের স্বার্থে এই দাঙ্গা। কিন্তু সেগুলোর বাস্তব দর্শন খুব কমই দেখা যায়, এসব চলচ্চিত্রে। একই কথা প্রযোজ্য দীপা মেহতার আর্থ ও তানভীর মোকাম্মেলের চিত্রা নদীর পারে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও। অবশ্য এ-সীমাবদ্ধতার দায়ভার আমি কেবল চলচ্চিত্র নির্মাতার ঘাড়েই দিতে চাই না। কারণ, প্রচলিত যেসব উৎস থেকে নির্মাতা এসব আখ্যান সংগ্রহ করেন, সেসব উৎস থেকেই মূলত এসব সীমাবদ্ধতার জন্ম। আমরা যদি আলোচ্য দুটি চলচ্চিত্রের মূল বিষয়বস্তু অর্থাৎ ৪৭ এর উপস্থাপন দেখি তাহলে দেখা যাবে-

ক. ৪৭-এর দৃষ্টিভঙ্গি

কিছু মানুষের দাবির মুখে ভারতবর্ষকে দুই ভাগ করে ফেলা হলো। জন্ম নিলো ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি আলাদা এবং একেবারে স্বাধীন রাষ্ট্র। আর্থচিত্রা নদীর পারে চলচ্চিত্র দুটিতে দেশভাগের বিষয়টি দেখানো হয়েছে খুবই স্বাভাবিকভাবে। লাহোরে বাস করা একটি পার্সি পরিবারকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলে আর্থ-এর কাহিনী। পরিবার-প্রধান সরকারি কর্মকর্তা। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চার সদস্যের পরিবার। শুধুই চার সদস্য বললে ভুল হবে। বাড়িতে আছে বেশ কয়েকজন কাজের লোক, যারা আবার বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী। মূলত তাদের সবাইকে নিয়েই সেই পরিবার। তবে চলচ্চিত্রটিতে দেখানো হয় ১৯৪৭ সালে দেশভাগোত্তর সময়ে লাহোরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিবারটির ভেঙে যাওয়ার কাহিনী। আর দাঙ্গার কারণ হিসেবে বলতে শোনা যায়, ভারত বিভক্ত হয়েছে নেহেরু আর জিন্নাহ্রকারণে।

একই কথা বলা যায় চিত্রা নদীর পারের ক্ষেত্রেও। এখানে দেখা যায়, চিত্রা নদীর পাড়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ একে একে দেশ ছাড়ছে। তাদের মধ্যেও এ-অনুভূতি দেখতে পাই-যা হতে যাচ্ছে, তাতে একসঙ্গে থাকা যাবে না। যদিও প্রধান চরিত্র শশীকান্ত উকিল যাওয়ার বিপক্ষে। কিন্তু তার ভিতরের চেতনায় কোনো রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক দর্শন খুঁজে পাওয়া যায় না। যে-চেতনাটুকু আছে সেটা তার না, মায়ের দেওয়া দিব্যি; আর চিত্রা নদীর পাড়ে তার অতীত স্মৃতির মায়া। চলচ্চিত্রটিতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে দেখি, তাদের ভিতরে কোনো বিভেদ নেই। তারা হিন্দু-মুসলমান বিভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে একে অপরের সঙ্গে মিশছে, খেলছে, হাসছে। বড়োরা কেনো দেশ ছাড়ছে, তার সম্পর্কে সঠিক কোনো কিছুই তারা জানে না। না-জানাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো যারা ছাড়ছে, তারা জানে না কেনো ছাড়ছে। সবাই ছাড়ছে তাই আমিও ছাড়ছি-Ñএই ছাড়ার দর্শন। চিত্রা নদীর পারে চলচ্চিত্রে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ধর্ষণ হওয়ার পর বাসন্তীর আত্মহত্যা। এ-আত্মহত্যার আলোচনায় পরে আসছি।

আমি আবারও বলে নিচ্ছি, চলচ্চিত্র দুটিতে যা-যা উপস্থাপন করা হয়েছে তার কোনোকিছুই অবাস্তব নয়। সবকিছুই ওই সময়ে ঘটেছে। মানে অতি-প্রত্যক্ষ ঘটনা। তাই আমি পরবর্তী আলোচনায় এ-দুটি চলচ্চিত্রের কিছু দৃশ্য নমুনা হিসেবে নিয়ে তার সম্প্রসারিত রূপ খোঁজার চেষ্টা করবো। পাশাপাশি চলচ্চিত্র দুটির দু-একটি বৈশিষ্ট্য দাঁড় করানোর চেষ্টা করবো।

 

খ. দাঙ্গা যখন বিচ্ছিন্ন ঘটনা

আলোচ্য দুটি চলচ্চিত্র দেখেই মনে হয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিষয়টি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। চিত্রা নদীর পারে-তে অবশ্য ১৯৪৭ সালে সংঘটিত দাঙ্গার আবহাওয়া এবং ৬৪-র দাঙ্গা উঠে এসেছে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর শুধু ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকারের জারি করা সামরিক আইনের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর বিরোধিতায় মিছিল করা ছাড়া আর কোনো ঘটনা দেখানো হয়নি। তারপর ছোট পরিসরে দেখানো হয়েছে ৬৪-র দাঙ্গা। আর সবশেষে দেখা যায়, শশীকান্ত উকিলের মৃত্যুর পর সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে তার মেয়ে ও বোনের দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমানো। কিন্তু লক্ষণীয়, এসব ঘটনার মধ্যে যে-দেড় দশকেরও বেশি ঐতিহাসিক সময় অতিবাহিত হয়েছে, তার কোনো ঘটনা কোথাও দেখা যায় না।

একইভাবে আর্থ-এ দাঙ্গার উপস্থাপন করা হয়েছে হঠাৎ ঘটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে। সেখানেও ভারত বিভাগের কোনো ঐতিহাসিক পরিস্থিতির উপস্থিতি পাই না। শুধু একবার পার্কে বসা বন্ধুদের আলোচনায় আসে দেশভাগের খবর, ভাইসরয় হাউজের খবর। কিন্তু আমরা জানি যেকোনো ঘটনার একটা চূড়ান্ত রূপ থাকে। যে-রূপটি আসে নানান ধরনের ছোট ছোট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই আসে পরিমাণগত পরিবর্তন। সেখানে নির্মাতা ৪৭-এর দাঙ্গা বা ৬৪-র দাঙ্গা যেটাই দেখাক না কেনো, সেটি কিন্তু গুণগত পরিবর্তন; পরিমাণগত পরিবর্তন থেকেছে উপেক্ষিত। কিন্তু পরিমাণগত পরিবর্তন আমার কাছে গুণগত পরিবর্তনের চেয়ে কখনই কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। কারণ, প্রভাবক বলতে যে-বস্তু বা বিষয়টি আছে সেটিই কিন্তু সব ঘটনার মূল। চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে দাঙ্গা; অর্থাৎ গুণগত পরিবর্তন। এখন আপনি যদি কেবল পানি ফোটার দৃশ্য দেখান। কিন্তু কিসের তাপে, কতো তাপে পানি ফুটলো তা না দেখান, তাহলে তো হলো না, তাই না?

অনেক সময় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর বিষয়টিও এখানে একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। যদিও বিষয়টি ক্ষমতা দিয়ে নির্ধারিত হয়। কিন্তু কোনো জাতি শুধু সংখ্যাগুরু আর লঘু হলেই কি দাঙ্গা বাধে? তাও না। এখানেও ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়, কে সংখ্যালঘু আর কে সংখ্যাগুরু। আবার সমস্যা শুরু হয় তখনও, যখন রাষ্ট্রের কিছু মানুষ একটি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী হয় এবং মনে করে, রাষ্ট্র তার পাশে আছে। তারা মনেই করে, তাদের পিছনে একটি দেয়াল আছে; দেয়াল আছে বলে, তারা কোনো ধরনের ভয়ে থাকছে না। ফলে তারা অন্য জাতিকে নিজেদের অধীনস্ত করার জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়। কেননা তাদের রক্ষাকর্তা হয়ে ছায়া দেয় স্বয়ং রাষ্ট্র। হয়তো এ-কারণেই দেশ ছাড়তে হয় অনেককেই। আর শশীকান্ত বাবুদের মতো লোকদের ভিটেছাড়া করার জন্য চাপ আসে অন্যদের তরফ থেকে। এই অন্যরা কে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  

অন্যদিকে আর্থ-এ যখন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে খাবার সময় কয়েক বন্ধু গল্প করে-ভারত বিভক্ত হলে লাহোর পড়বে পাকিস্তানে, কারণ সেখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। তাদের আরেক বন্ধু এর বিরোধিতা করে বলে, লাহোর পাকিস্তানে নয়, ভারতে পড়বে। এবং তর্কের এক পর্যায়ে সেই হিন্দু বন্ধুটি বলে, আসলে জনসংখ্যা কোনো বিষয় নয়, বিষয় টাকা। তার যুক্তি-Ñলাহোরে বড়ো বড়ো হিন্দু ব্যবসায়ী আছে, যারা একে ভারতের ভিতরে নিতে ভূমিকা রাখবে। তার কথামতো এখানে টাকা সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করে, সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু নয়। যা এখানে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।

এসব চলচ্চিত্র দেখে আমার মোটা দাগে যে-অনুভূতি তা অনেকটা এরকম-মানুষ মানুষকে নির্মমভাবে মারছে। এরা কোনো যৌক্তিকতার বিচার করছে না। কোনো কিছু বোঝার চেষ্টা করছে না। আবার এ-ও বোঝা যায়, এরা সবাই সাধারণ মানুষ; কোনো সরকার, কিংবা রাজনৈতিক গোষ্ঠীপালিত গুণ্ডাবাহিনী নয়। তাহলে তো এদের এতো নির্দয় হওয়ার কথা না; পশুর মতো রক্তের নেশা থাকার কথা নয়! তাহলে কি কোনো শক্তি এদের মগজ ধোলাই করছে; প্রশ্ন জাগে মনে? আর সেই শক্তি কি কেবল এককভাবে ধর্মই নিয়ন্ত্রণ করে, নাকি অন্য কেউ? উত্তর মেলে না, এসব চলচ্চিত্রে!

 

ব্যক্তিগত বিষয় যখন দাঙ্গা হয়ে ওঠে

নিম্নবর্গের ইতিহাস বই থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। জব্বলপুর ১৯৬১ : একটি হিন্দু মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে মুসলিম যুবকের বিয়ে করাটা আপাত কারণ ছিল। এর ফলে দুই সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংস্কারগুলো জোরদার হলেও প্রকৃত কারণ অন্যত্র নিহিত ছিল। মুসলিম যুবকটি স্থানীয় একজন বিশেষ সম্পন্ন বিড়ি ব্যবসায়ীর ছেলে এবং ব্যবসায়ীটি ধীরে ধীরে স্থানীয় বিড়ি শিল্পের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। এই উন্নতির দরুন তাঁর প্রতিযোগীদের তাঁর উপর বিদ্বেষ ছিল। এই বিষয় খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, ওই দাঙ্গায় মুসলিম মালিকানার অধীন বিড়ি শিল্পগুলি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করার সঙ্গে সঙ্গে যে-দাঙ্গার কথা বলা হচ্ছে, তা কি আসলে সম্ভব? একটু আগেই বলেছি, দাঙ্গা ঘটে কোনো ঘটনার একটা পর্যায়ে এসে। যেটিই এর চূড়ান্ত রূপ। আর যেখানে থাকে অসংখ্য প্রভাবক। যা তাকে দাঙ্গায় রূপদান করে। এগুলোকে অস্বীকার করে যদি আমরা কেবল হিন্দু বা মুসলমানের কথা কাটাকাটিকেই দাঙ্গার কারণ ধরি তাহলে আর মূলে যাওয়া হবে না।

কিন্তু পাঠক লক্ষ করুন, এখানে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করাটা মূল কারণ ছিলো না। মূল কারণ কোথায় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মুসলিম ব্যবসায়ী যেনো সেই এলাকার বিড়ি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, তাই ছিলো হিন্দু ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ এখানে ব্যক্তিগত বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটা এক সময় সামষ্টিক হয়ে দাঙ্গায় রূপ নিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে। একই অবস্থা আমরা আর্থ-এ দেখি। সেখানে নির্মাতা ৪৭-এর দাঙ্গার মধ্যে একটি প্রেমের কাহিনী তুলে ধরেছেন। যদিও প্রেমটি ছিলো ত্রিমুখী। পার্সি পরিবারের গৃহপরিচারিকা শান্তাকে পেতে চায় দুই মুসলিম যুবক হাসান ও দিল নাভাজ। কিন্তু শান্তা ভালোবাসে হাসানকে। যখন হাসান শান্তাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত, ঠিক তখনই সে খুন হয়। কে খুন করে তা নির্মাতা না দেখালেও এটা স্পষ্ট যে, তার খুনি দিল নাভাজ। এবং শেষ পর্যন্ত এই না পাওয়াকে দিল নাভাজ রূপ দেয় সামষ্টিকের বিষয় হিসেবে। আসলে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। দিল নাভাজ হয়তো তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে হাসানের সঙ্গে শান্তার সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ সে হাসানকে হত্যা করে। আপত্তি নেই, যেহেতু এটি স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক লাগে এটিকে প্রভাবক হিসেবে দেখালে। আমার মতে, এটি প্রভাবক হতে পারে না, এটি কেবল দাঙ্গার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই হতে পারে। কারণ, এটি যদি দাঙ্গার প্রভাবক হয়, তাহলে আসল প্রভাবক হারিয়ে যাবে। আরেকটি বিষয়; দিল নাভাজ যদি শান্তাকে পেতেন, তাহলে চলচ্চিত্রে দাঙ্গা কি বন্ধ হয়ে যেতো? বরং বলা যায়, নারীদেহ নিয়ে বিবাদমান পুরুষের কাড়াকাড়ির কারণে অনেক সময় সংঘাত প্রভাবিত হয়েছে, প্রেম নিয়ে নয়।

একইভাবে চিত্রা নদীর পারে-তে যখন শশীকান্ত উকিলকে তার প্রতিবেশী বলছে, যদি তারা ভারত চলে যায়, তাহলে যেনো বাড়িটা তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। অথবা শশীকান্ত যখন তার আত্মীয় নিধু ডাক্তারের বাড়িতে গিয়ে গল্প করে, তখন তারা জানায়-প্রতি রাতে তাদের ঘরের চালে ঢিল পড়ে। ঢিল মারা কি সামষ্টিক কোনো কাজ হতে পারে-নাকি ব্যক্তিগত, তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। যেমন ভেবে দেখা দরকার, সেই মুসলমান বিড়ি ব্যবসায়ীর কথা। সে যদি বিড়ি ব্যবসায় লোকসানের সম্মুখীন হতো বা বাজার দখল করতে ব্যর্থ হতো তবে কি সেই জব্বলপুরের দাঙ্গা বাধতো? সেখানে দাঙ্গা বাধতো, কী বাধতো না, তা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। আর সেখানে ব্যক্তিগত বিষয়কে কতোটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা আমরা দেখতেও পাই। পাঠক খেয়াল করুন, সেখানে কীভাবে ব্যক্তিগত বিষয় এবং শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থ সামষ্টিক করা হয়েছে, আর বাধানো হয়েছে দাঙ্গা।

 

ঘুড়ি তুমি কার আকাশে ওড়ো

মানুষের যেকোনো ঘটনা বা স্থানকে দুভাগে ভাগ করা যায়। একটি ভিতর, অন্যটি বাহির। আর এর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে সর্বদা। চিত্রা নদীর পারে বিধবা বধু বাসন্তী ধর্ষণ হওয়ার পর আমরা তার বাহিরের রূপটিই দেখতে পাই। দেশভাগকে কেন্দ্র করে মেয়েদের উপর যে আক্রমণ, তা শুধু শত্রু পক্ষের পুরুষদের কাছ থেকেই আসেনি। তার চেয়েও মর্মান্তিক তাদের আত্মীয় পুরুষদের প্রতারণা। এই প্রতারণার কথা তারা মুখে বলে না...। কিন্তু মুখের ভাষা নিরব থাকলেও শরীর তার নিজের ভাষায় এই যন্ত্রণা প্রকাশ করে ফেলে। হয়তো বাসন্তী বুঝেই গিয়েছিলো তার পরিবার, তার সমাজ তাকে আর গ্রহণ করবে না। বাসন্তী হয়তো এও ভেবেছিলো-তার শরীরে যে-আঘাত লেগেছে বা তার শরীরে যে-দাগটি পড়েছে, সেটি আর কখনই সারবে না। যে-আঘাতের গল্প সে কারো কাছে করতে পারেনি, প্রকাশ করতে পারেনি তার গভীর যন্ত্রণার কথা। তার শরীরী ভাষায় যা অল্প হলেও প্রকাশ পেয়েছে। তাই তার বাঁচার ইচ্ছেটাকে সে ব্যক্ত করতে না পেরে, নিজেকে প্রতিমার মতোই বিসর্জন দিয়েছে।

একইভাবে কেউ জানতে পারে না, লাহোরে আসা সেই লাশ বোঝাই ট্রেনে থাকা দিল নাভাজের বোনদের কথা। কিংবা গৃহপরিচারিকা হিন্দু মেয়ে শান্তার শরীরে পড়া মুসলমান পুত্র হাসানের ভালোবাসার দাগ। যে-ভালোবাসার জন্য তাকে বলি হতে হয় দাঙ্গার। শেষ পর্যন্ত যার ভিতর বা বাহিরের কোনো খবরই আমরা পাই না। কিন্তু পরিবার বা সমাজ একবারও ভাবে না, সে পরিস্থিতির শিকার। তারা ধরেই নেয়, তার সব গেছে। মানুষের, তার জীবনের কোনো মূল্য সমাজ দিতে পারে না। চলচ্চিত্রে সবসময় মানুষের বাহিরের দিকটাকে তুলে ধরা হয়। নির্মাতারা কখনই এমন কোনো বিষয় উপস্থাপন করে না, যেখানে কেবল নারীর শরীরের ক্ষতই প্রকাশ হয় না,  উঠে আসে ভিতরের ক্ষতটাও।

 

শেষ কথা

ইতিহাস সবসময় ক্ষমতাবানদের কথা বলেছে আমরা জানি। যে-কারণে ভারত বিভাগের সময়ের অনেক কাহিনী ইচ্ছে করে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে এমনও ঘটেছে-Ñচোখের সামনে ঘটে চলা অনেক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে অস্বীকার করা হয়েছে। স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অনেক সময় ইতিহাসকে করে ফেলা হয়েছে উল্টো। ... সেই ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামই যেহেতু এই ইতিহাসের মূল উপজীব্য, উনিশ শতকের গোড়া থেকেই এর কাহিনী তাই পর্যবসিত হয়েছে ভারতীয় জাতি-রাষ্ট্রের জীবন কাহিনীতে। একই কারণে এই ইতিহাসে দেশভাগের কাহিনী, আর সেই সঙ্গে ১৯৪৬-৪৭ সালের হিন্দু-মুসলিম এবং মুসলিম-শিখ দাঙ্গার কাহিনী, এক রকম প্রায় এড়িয়েই যাওয়া হয়েছে। যেহেতু বর্তমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গানির্ভর চলচ্চিত্রগুলো ইতিহাস থেকে ঘটনা নিয়ে নির্মিত তাই এগুলোতেও দেখা যায়, অনেক কিছুরই অনুপস্থিতি। যেমনটা ব্যতিক্রম হয়নি চিত্রা নদীর পারে কিংবা আর্থ-এ।

একেবারে শেষে এসে একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর দিতে চাই। প্রশ্নটি হলো, তাহলে দাঙ্গা নিয়ে কেমন চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়া উচিত? আমার উত্তর হলো-চলচ্চিত্র এমন একটি জিনিস যার একটি শট্ই অনেক কথা বলে। ক্যামেরা দূর থেকে ধরা হয়েছে, না কাছ থেকে ধরা হয়েছে, তার ওপরই অনেক ধরনের অর্থ তৈরি হয়। তাই এ-ধরনের চলচ্চিত্রে যেনো কেবল ক্লোজ শট্ই না থাকে। পাশাপাশি লং শট্ও যেনো থাকে। যেখানে ক্লোজ শটে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে-এমন অতি-প্রত্যক্ষ ঘটনাও উঠে আসবে। আর মহাকাশ থেকে নেওয়া লং শটে দেখা যাবে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে।

 

লেখক : ইমরান হোসেন মিলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

milonmcru@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. খান, কলিম (২০১১ : ৭); ভূমিকা; পরমাভাষার সংকেত; প্যাপিরাস, ঢাকা।

২. খান, কলিম (শ্রাবণ ১৪০৬ : ৭৫); মৎসাবতার : জ্ঞানের ব্যক্তিমালিকানা : ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট; দিশা থেকে বিদিশায়;  হাওয়া ৪৯ প্রকাশনী, কলকাতা।

৩. রাসেল, বার্ট্রাণ্ড (২০১১ : ১৩); উপক্রমণিকা না উপসংহার?; মানুষের কোনো ভবিষ্যৎ আছে?; অনুবাদ-অসীম চট্টোপাধ্যায়, সন্দেশ, ঢাকা।

৪. সরকার, দেবপ্রসাদ; কমরেড বাংলা ভাষায় দাঙ্গা শব্দ ছিল না; হাওয়া ৪৯, অপর : আদার; সম্পাদনা-অরবিন্দ প্রধান; ত্রয়োবিংশ সংকলন, আগস্ট-২০০২, পৃষ্ঠা-১৪০, হাওয়া ৪৯ প্রকাশনী, কলকাতা।

৫. প্রাগুক্ত; সরকার, দেবপ্রসাদ (বর্ষা ১৪০৯ : ১৪০)।

৬. গোস্বামী, অঞ্জন (২০০৩ : ১৭); গোড়ার কথা; ইতিহাস চর্চা : বিষয় সাম্প্রদায়িকতা; চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা।

৭. পাণ্ডে, জ্ঞানেন্দ্র (২০০৪ : ২৭১); ভগ্নাংশের সমর্থনে: দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়?; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা-গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

৮. দাশ, বীণা (২০০৪ : ১৮৭); হিংসা, দেশান্তর ও ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা-গৌতম ভদ্র, পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

৯. প্রাগুক্ত; পাণ্ডে, জ্ঞানেন্দ্র (২০০৪ : ২৭১)।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন