Magic Lanthon

               

মো. জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত ২২ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘গরিব-দুখিরা এখনকার এই বই দেখে না, এই বই তারা আগে দেখেছে’

মো. জাহাঙ্গীর


প্রেক্ষাগৃহে টানা প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে কাজ করছেন মো. জাহাঙ্গীর। রাজশাহী নগরীতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম প্রেক্ষাগৃহ অলকায় (পরবর্তী সময়ে স্মৃতি সিনেমাহল) ১২ বছর বয়সে চলচ্চিত্রের প্রচারের কাজ দিয়ে তার কর্মজীবনের শুরু। এরপর প্রেক্ষাগৃহে কাজ করেছেন পিয়ন, পয়েন্ট্রি (লাইনম্যান), টিকিট কালোবাজারি ও নৈশপ্রহরী হিসেবে। বাবা কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, কিন্তু জাহাঙ্গীরের সেটা ভালো লাগতো না। তাই সময় পেলেই চলে যেতেন প্রেক্ষাগৃহে। এভাবেই একদিন প্রেক্ষাগৃহে তার চাকরি হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর প্রথম দিকে প্রেক্ষাগৃহের ম্যানেজারের এটা-ওটা আনা-নেওয়া করতেন; কোনো দিন কারো অনুপস্থিতিতে ড্রেস সার্কেলে কাজ করতেন পয়েন্ট্রির। এর সঙ্গে নিয়মিত যেটা করতেন তা হলো, চলচ্চিত্র দেখা। অলকার বাইরেও তখন রাজশাহীতে থাকা আরো দুটি প্রেক্ষাগৃহে (বর্ণালী ও উৎসব) তিনি চলচ্চিত্র দেখতেন নিয়মিতই।

পরে অলকার মালিকানা পরিবর্তন হলে জাহাঙ্গীরসহ সেখানকার সব পুরনো কর্মচারীর চাকরি চলে যায়। কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের মায়া ছাড়তে পারেন না জাহাঙ্গীর। এবার টিকিট কালোবাজারি শুরু করেন সদ্য চালু হওয়া উপহার সিনেমাহলে (উপহার সিনেমা লি. ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে)। প্রায় দেড় দশক সেখানে তিনি টিকিট কালোবাজারি করেছেন। এরপর ৯০ দশকের শেষের দিকে সেখানেই নৈশপ্রহরীর চাকরি পান জাহাঙ্গীর। এখন রাতে প্রহরীর কাজ আর বাকি সময় কালোবাজারে টিকিট বিক্রি করেন তিনি। দীর্ঘ সময় প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে জড়িত চলচ্চিত্রের পেশাজীবী ব্রাত্য এই মানুষটির সঙ্গে ১৩ মে ২০১৫ ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পক্ষ থেকে কথা বলেছেন কাজী মামুন হায়দার

 

ম্যাজিক লণ্ঠন : বোঝে না সে বোঝে না কেমন চলছে? (এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় উপহার সিনেমায় মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি চলছিলো)

মো. জাহাঙ্গীর : এই বই (চলচ্চিত্র) চলছে না, লোক ভালো নাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : চলছে না কেনো?

জাহাঙ্গীর : ডিরেক্টর ভালোই, কিন্তু ছবিটা ভালো মতো করতে পারেনি। এই হলো ব্যাপার।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কী ধরনের, মানে কী করতে পারেনি?

জাহাঙ্গীর : ছবিটার সৌন্দর্য করতে পারেনি। মানুষ যে ছবিটা দেখবে, তার তো একটা ইন্টারেস্ট লাগবে, দর্শক হবে। এর আগে যে রকম একটা ছবি হয়ে গেলো, আপনার ...।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ওয়ার্নিং?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, ওয়ার্নিং হয়ে গেলো। ছবিটাতে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। দর্শকও ভালো হয়েছে, ছবিও দেখেছে। এ রকম ছবি হলে বাংলাদেশের দর্শক ছবিটা দেখবে। মহিলা, ভদ্রমহিলাদেরকে নিয়ে দেখার মতো ছবি এইগুলা। তাছাড়া যে রকম ছবি চলছে, এই ছবি দেখার মতো কিছু নাই। লোকজন সিনেমা শেষ না করেই মহিলাদেরকে নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। এই বই ভালো না, গানও ভালো না। দেখার কিছু নাই। বই ভালো হলে দর্শক এমনই দেখবে; সিনেমাহলে ভিড় হবে। বই ভালো না হলে সিনেমাহলের ব্যবসাও চলবে না; সিনেমাহলও বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক মালিক তো এখন সিনেমাহল বেচে দিচ্ছে, ভেঙে ফেলছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে কিছুদিন আগে ভারতের সিনেমাগুলো চললো ... ।

জাহাঙ্গীর : ভারতের সিনেমাগুলো চলবে। তবে ভারতে মুক্তি পাওয়ার সাত দিন, ১৪ দিনের মধ্যেই এখানে চালাতে হবে। কিন্তু যেগুলো টিভিতে হয়ে গেছে ৫০-৬০ বার, একশো বার¾সেসব ছবি চলবে না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা, আপনি তো অনেকদিন এটার সঙ্গে জড়িত আছেন। এই যে ভারতীয় সিনেমা যদি বাংলাদেশে আসে, তবে বাংলাদেশের সিনেমার কোনো ক্ষতি হবে না?

জাহাঙ্গীর : বাংলাদেশের সিনেমার কী ক্ষতি হবে!

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি বললেন, ওখানে মুক্তি পাওয়ার সাত দিন পরে এখানে আসলে ...।

জাহাঙ্গীর : ওখানে মুক্তি পাওয়ার সাত দিন বা ১৪ দিন পরে এখানে আসলে কিছু সেল (বিক্রি) পাওয়া যাবে। লোকে দেখবে, আগ্রহ থাকবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : বাংলাদেশের সিনেমার কোনো ক্ষতি হবে না?

জাহাঙ্গীর : বাংলাদেশের ছবির ক্ষতি হবে কী করে! বাংলাদেশের ডিরেক্টরদেরও ওদের মতো ছবি করতে হবে। যদি এরাও ওদের মতোই ছবি করে, তাইলে বাংলাদেশের ছবি ‘মার খাবে’ কী করে? ধরেন, পাকিস্তান পিরিয়ডে বাংলাদেশের ছবিও চলেছে, পাকিস্তানের ছবিও চলেছে। তখন বাংলাদেশের ছবি চলেনি? মানুষ সিনেমাহলে গিয়ে বাংলাদেশের ছবির টিকিট পায়নি। মারামারি লেগে গেছে, তখন তো বেশি সিনেমাহল ছিলো না। তার মানে পাকিস্তান পিরিয়ডেও বাংলাদেশের ছবি চলেছে। তখন কী করে বাংলাদেশের ডিরেক্টররা ছবি করেছে? ময়নামতি, অবুঝ মন, বেহুলা সুন্দরী¾এইগুলো কী রকম চলেছে! বাম্পার। দুই ভাই, সাত ভাই চম্পা, রাখাল বন্ধু¾এসব বই তখন চলেনি? তখন ছেলে-মেয়েরা সিনেমাহলে জায়গা পায়নি ছবি দেখার মতো। এটা ঠিক তখন অবশ্য বিনোদনের আর কিছু ছিলো না। টিভি ছিলো না, ডিশ ছিলো না। এই জন্য দর্শক তখন খালি সিনেমার ওপর দিয়ে একটু আনন্দ করেছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার দেখায়, এই অঞ্চলে নারী দর্শক কেমন ছিলো?

জাহাঙ্গীর : ভালো, তবে এখন মহিলা কমে গেছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কী কারণে?

জাহাঙ্গীর : দেখছে না। কারণ বাড়িতে ডিশ হয়ে গেছে। হাতে মোবাইলফোন হয়ে গেছে। ছবি দেখছে মোবাইলে। তিনটা-চারটা ছবি দেখতে চাইলে ১০ টাকা, ১৫ টাকা দিলেই কেনা যাচ্ছে। এরা আরামে ছবি দেখছে। তবে তার পরও কিছু দর্শক আসছে। তারা কারা আসছে? আপার লেভেলের ছাত্র-ছাত্রী যারা, তারাই কিছু বই দেখছে। তাছাড়া বাড়ির লোক, ফ্যামিলির লোক খুব কম। এরা আগের মতো বই দেখা ছেড়ে দিয়েছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সেটা কি শুধুই ডিশ অ্যান্টেনার কারণে?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, ডিশের কারণে। ডিশের কারণেই তো দেখছে না। বাড়িতে সব চ্যানেল মিলে তারা সারাদিন কম করে হলেও ২০টা বাংলা ছবি দেখছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তার মানে তারা সিনেমা দেখছে?

জাহাঙ্গীর : সিনেমা তো দেখছেই, তবে ডিশে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কিন্তু সিনেমাহলে এসে দেখছে না?

জাহাঙ্গীর : সিনেমাহলে গিয়ে দেখবে কী করে? সিনেমাহলে আসছে, টিকিটের দাম বেশি। এই জন্য দর্শক আসছে না। তার পর ছবিও ভালো না, ভালো হলে আসছে। যেমন ধরেন, কিছুদিন আগে যে রকম রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট ছবিটা চললো, প্রচুর ছেলে-মেয়ে। সব দর্শক ছাত্র-ছাত্রী। ছাত্র-ছাত্রীরা বাম্পার দেখলো। আবার ফ্যামিলিও দেখলো কিছু। এ রকম ছবি যদি চলে, তাহলে দর্শক একটু দেখবে। দর্শক যদি বই দেখে আনন্দ না পায় তাহলে কেনো দেখবে? এই জন্য দেখেন বাংলাদেশের সিনেমাহল ভেঙে ফেলছে, বেচে দিচ্ছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার কী মনে হচ্ছে, এই সিনেমাহলগুলো কি আদৌ রাখা সম্ভব হবে?

জাহাঙ্গীর : লস হলে তো কোম্পানি সিনেমাহল রাখবে না। মনে করেন, একটা ছবি এক লাখ টাকা বা দেড় লাখ টাকা এম জি (গ্যারান্টি মানি, কোনো প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রযোজনা-পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানকে নিশ্চয়তা হিসেবে যে টাকা দিতে হয়) দিয়ে আনতে হয়। এনে ছবির টাকা ওঠে না। আরো পকেট থেকে কোম্পানিকে দিতে হয়। তাহলে মালিক এখন স্টাফ বেতন কী দিয়ে দিবে? কারেন্ট (বিদ্যুৎ) খরচ কী দিয়ে দিবে আর কী দিয়ে নিজে বাঁচবে? এই হয়ে গেছে সমস্যা। সিনেমা ভালো হলে দুটো লোক হচ্ছে, সিনেমা ভালো না হলে লোক হচ্ছে না। বছরে দুই-একটা সিনেমা ভালো হচ্ছে। এই হলো ব্যাপার।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন একটু নিজের কথা বলেন। আপনি সিনেমাহলের এই চাকরি শুরু করলেন কীভাবে?

জাহাঙ্গীর : আমি প্রথম শুরু করেছিলাম ‘অলকা সিনেমা’ (রাজশাহীর প্রথম প্রেক্ষাগৃহ, প্রথমে এর নাম ‘অলকা সিনেমা’ থাকলেও পরে হয় ‘স্মৃতি সিনেমা’। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রেক্ষাগৃহটি বন্ধ হয়ে গেলে পরে তা ভেঙে বাণিজ্যিক ভবন করা হয়।) থেকে। ‘অলকা’ সিনেমাহলে পাকিস্তান পিরিয়ডে চাকরি শুরু করি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : অলকা মানে স্মৃতি?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, স্মৃতি সিনেমাহল।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই স্মৃতি সিনেমাহলের নামই তো আগে অলকা ছিলো?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, ওইটাই অলকা ছিলো আগে। পরে এরা স্মৃতি সিনেমাহল নাম দিলো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তার পর কী হলো?

জাহাঙ্গীর : আমি ওখানে চাকরি করতে করতে ছেড়ে দিয়ে এই হলে আসলাম।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ওখানে কী হিসেবে চাকরি শুরু করলেন?

জাহাঙ্গীর : ওখানে প্রথমে পিয়নের চাকরি করতাম, পরে পয়েন্ট্রি করতাম। কখনো দোতলায় থাকতাম; আবার কখনো প্রচারম্যান ছিলাম, পাবলিসিটি করতাম।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে পাবলিসিটি করতেন, তার অভিজ্ঞতা কেমন? তখন মানুষের সাড়া কেমন ছিলো?

জাহাঙ্গীর : তখন সাড়া খুব ভালো ছিলো। অতোটা প্রচারই লাগতো না। এখন গোটা শহরে তিনশো-চারশো পোস্টার মারতে হয়। তখন তো আমি এতো পোস্টার লাগাতাম না। ৩০-৪০টা লাগালেই তো এনাফ। গোটা শহরের লোক এসে সিনেমাহল ভর্তি হয়ে যেতো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মাইকে প্রচার করতেন না?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, মাইকিং করতাম।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তখন মানুষের সাড়া কেমন ছিলো?

জাহাঙ্গীর : মানুষ তো তখন সিনেমা দেখার জন্য পাগলা ছিলো। তখন বহু দর্শক ছিলো সিনেমা দেখার। অলিগলিতে যেতাম, মেয়ে দর্শক আসতো সিনেমার পোস্টার দেখার জন্য। আর সিনেমাহলে ফ্যামিলি আসতো, তাদের বাচ্চাদের নিয়ে বই দেখতে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে আপনি প্রথমে অলকা দিয়ে শুরু করলেন। অলকাতে কতোদিন চাকরি করেছেন?

জাহাঙ্গীর : অলকাতে বহুদিন ...।

ম্যাজিক লণ্ঠন : অলকা, মানে স্মৃতি না ভাঙা পর্যন্ত কি ছিলেন?

জাহাঙ্গীর : আসলে, ওটা ছিলো রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের ভবন। সরকারের কাছ থেকে টেন্ডারের মাধ্যমে এটা লিজ নিতে হতো। সরকার যখন টেন্ডার দিলো, তখন আমরা যে মালিকের আন্ডারে ছিলাম ওই লোক আর সেটা পেলো না। অন্য মালিক নিয়ে নিলো সিনেমাহলটা। তারা যখন সিনেমাহলটা নিলো, তখন আমরা সবাই বাদ পড়লাম। যতো স্টাফ ছিলো সব বাতিল। তখন তো আমরা বেকার, তার কিছুদিন পর এই সিনেমাহলটা (উপহার সিনেমা লি.) চালু হলো। আমি এসে এখানে ঢুকলাম।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখানে কী হিসেবে ঢুকলেন?

জাহাঙ্গীর : প্রথমে এসে টিকিট বেচতে লাগলাম ব্ল্যাকে। এই ব্ল্যাকে টিকিট বেচার কাজ আমি এখানে অনেকদিন করেছি। পরে সিনেমাহলে যখন লোক শর্ট হলো, তখন গার্ডে ঢোকালো আমাকে। হাবিলদার বলে এক ভদ্রলোক ছিলো এখানে। পুলিশের চাকরি করতো বেচারি। ও বললো, ‘জাহাঙ্গীর তুমি চাকরি করবা?আমি বললাম, হ্যাঁ, করবো। অসুবিধা নাই।’ ‘বেতন পাবা তিনশো টাকা। আমি বললাম, দেন, অসুবিধা নাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আর সঙ্গে কি ব্ল্যাকে টিকিট বিক্রি করতেন?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, ওই টিকিট বেচতাম। আর কিছু না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তার পর, এখানে কতোদিন হলো প্রায়?

জাহাঙ্গীর : এখানে সিনেমাহল চালু হওয়া ৩০-৩১ বছর। ৩০ বছর ধরে আমি এই সিনেমাহলেই আছি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে ১৯৯৯ থেকে ২০০৩-০৪ পর্যন্ত সময়টাতে প্রচুর কাটপিসওয়ালা সিনেমা চলেছে।

জাহাঙ্গীর : এই সিনেমাহলে কখনোই কাটপিসের কোনো বংশ ছিলো না। সেসময় চলেছে অন্য সিনেমাহলে। কল্পনা, বর্ণালী, স্মৃতি¾এই সিনেমাহলগুলোতে চলেছে। তবে এই সিনেমাহলে কোনোদিন চলেনি। এক সিনও চলেনি। আমার মালিক বলতো, ‘হলে আমার যদি একটা লোক নাও হয়, তাও আমি এ জিনিস চালাবো না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এটা মালিকের কথা?

জাহাঙ্গীর : হুম, মালিকের। তিনি বলেন, আমার হলে এ জিনিস চলবে না। এক সিন থাকলেও কেটে দিতে হবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার তো অভিজ্ঞতা অনেক। আপনার কী মনে হয়, এগুলো আমাদের সিনেমার কী রকম ক্ষতি করেছে?

জাহাঙ্গীর : এটা তেমন ক্ষতি করে নাই। সিনেমাহলের ক্ষতি হয়েছে ডিশ লাইন থেকে। সব থেকে বেশি ক্ষতি করে ফেলেছে ডিশ লাইন।

ম্যাজিক লণ্ঠন : অনেকে যে কাটপিসের কারণে ক্ষতির কথা বলে, এটা ...।

জাহাঙ্গীর : এটা হয়তো একটা নির্দিষ্ট সময়ে ছিলো। কিন্তু এখন তো আর সেই সিস্টেম নাই। বাংলাদেশে এখন ওগুলা চলছে না, সব বন্ধ। কোথাও চলে না এ জিনিস। আগের যুগে ছিলো। তখন দর্শক দেখেছে কিছু। বাস্, এই শেষ আর নাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন এই সিনেমাহলে কী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আপনি?

জাহাঙ্গীর : আমি এখনো গার্ডেরই চাকরি করি এখানে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : বেতন কতো টাকা পান?

জাহাঙ্গীর : বেতন বেশি না, সাড়ে তিনশো টাকা।

ম্যাজিক লণ্ঠন : চলে কীভাবে তাহলে?

জাহাঙ্গীর : চলে, এজন্য সাইড ইনকাম করতে হয়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : অন্যান্য যে কর্মচারীরা আছে তাদের বেতন কেমন?

জাহাঙ্গীর : পয়েন্ট্রির বেতন পাঁচশো-ছয়শো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আর টিকিট বিক্রি করেন যিনি?

জাহাঙ্গীর : ওই একই রকম আর কি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : না, মানে যারা কাউন্টারে টিকিট বিক্রি করে?

জাহাঙ্গীর : ওদের খুব একটা বেনিফিট নাই। ওখানে আমরা যা দিই তা-ই। ধরেন আমরা টিকিট প্রতি এক টাকা দিই চা-টা খেতে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সিনেমাহল থেকে তাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না?

জাহাঙ্গীর : ওরাও বেতন পায়, এই ধরেন সাতশো-আটশো টাকা।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে মাইকে যারা পাবলিসিটি করে বেড়ায় তাদের বেতন কতো?

জাহাঙ্গীর : ওকে তো ওইভাবে কিছু দেয় না। একদিন পাবলিসিটি করলে রিকশা ভাড়া দুইশো-আড়াইশো টাকা থাকে। আর পকেট খরচের জন্যে ৫০-৬০ টাকা দেয়। নাস্তা-পানি খেতে, চা-পান খেতেই তো সেটা লাগে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আর পোস্টার যিনি লাগান?

জাহাঙ্গীর : ওই লোকদের কথাই তো বলছি। যে পোস্টার লাগায় তাকে ৭০-৮০ টাকা দেয় চা-পানি খেতে। আর যে রিকশা চালক আছে ওকে দুইশো-আড়াইশো টাকা দেয়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এমনি ওর বেতন নাই, মাসিক?

জাহাঙ্গীর : না, ওর কোনো বেতন নাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই সিনেমাহলে মালিকের বাইরে সবচেয়ে বড়ো পোস্টে কে আছেন?

জাহাঙ্গীর : মালিকের পরে হলো ম্যানেজার। ম্যানেজারই তো এইটা চালায়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তার পরে কে আছে?

জাহাঙ্গীর : তার পরে একজন সুপারভাইজার আছে। উনি এই হাউজ মেইনটেইন করে। স্টাফরা কী করছে, না করছে সেটা মেইনটেইন করে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সুপারভাইজারের বেতন কী রকম?

জাহাঙ্গীর : ওরও আটশো-নয়শো টাকার মতোই হবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সুপারভাইজারের পরের লোক কে?

জাহাঙ্গীর : ক্যাশিয়ার। আটশো-নয়শো টাকা বেতন ওদেরও।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আগে তো ৩৫ মি মি-এ সিনেমা চালানো হতো, তাই না? এখন তো ডিজিটালে চালানো হয়। ৩৫ মি মি-এ চালানো আর ডিজিটালে চালানো-এর মধ্যে কী কোনো পার্থক্য মনে হচ্ছে আপনার?

জাহাঙ্গীর : আগে যখন থার্টিফাইভে ছিলো, তখন তো অপারেটর লাগতো; দুইটা-তিনটা অপারেটর থাকতো। এখন তো অপারেটর লাগে না। একটা লোকই ছবি চালায়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ছবির গুণগত মানের কোনো পরিবর্তন আসছে?

জাহাঙ্গীর : ডিজিটাল হওয়াতে দর্শক ছবিটা একটু ভালোভাবে দেখছে। এখন দেখতে ভালো লাগে। এই জন্য দর্শক দেখছে। আর ওটা তো (৩৫ মি মি) দেখতে ভালো লাগতো না। পর্দাটা ছোটো লাগতো, কাঁপতো। খারাপ লাগতো দেখতে। আর এইটাতে পর্দা বড়ো, ছবি দেখে আরাম লাগে, ছবিটা ক্লিয়ার। কতো সুন্দর লাগে দেখতে। তাছাড়া আর কি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই সিনেমাহলটা কি এখন জাজ মাল্টিমিডিয়ার নেওয়া?

জাহাঙ্গীর : না, হল মালিকই চালায়, তবে প্রজেকশন মেশিন ওদের। বাংলাদেশে তো সব সিনেমাহলে জাজ’ই আছে। ধরেন ৭০-৮০ সিনেমাহলে তো ওদেরই মেশিন আছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : হিসাবটা কী উনাদের সঙ্গে?

জাহাঙ্গীর : ওইটা তো আমি বলতে পারবো না। উপরের খবর আমি বলতে পারবো না। ওইটা আমার এরিয়ার ভিতরে নাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে এই মেশিন জাজ-এর?

জাহাঙ্গীর : হুম, জাজ-এর মেশিন।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আচ্ছা আর একটা বিষয়, সিনেমা যে রেন্টে আনা হয়, ওটার হিসাব কী বলতে পারবেন?

জাহাঙ্গীর : ওই যে আপনাকে তো বললাম। ধরুন, দেড়-দুই লাখ টাকা দিয়ে নিয়ে আসে ...।

ম্যাজিক লণ্ঠন : দেড় লাখ টাকা। এগুলো কি গ্যারান্টি মানি দিয়ে নিয়ে আসে?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ। প্রথমে ওখানে টাকা দিয়ে আসতে হয় কিছু। তারপর সেল যা হবে তাই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন কোন টিকিটের দাম কতো?

জাহাঙ্গীর : দোতলায় মানে ড্রেস সার্কেল (ডি সি) ৫২ টাকা। নীচে (প্রথম শ্রেণি) ৪২ টাকা। সামনে ৩২ টাকা।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখানের ট্যাক্সের হিসাবগুলো জানেন আপনি?

জাহাঙ্গীর : অতো তো আমি বলতে পারবো না, এগুলা উপর লেভেলের ব্যাপার। ম্যানেজার-সুপারভাইজাররা এটা বলতে পারবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন একটু বলেন তো, বর্তমানে যে নায়ক-নায়িকা আসছে, আর আগে যে নায়ক-নায়িকা ছিলো-এদের মধ্যে পার্থক্য কেমন?

জাহাঙ্গীর : আগের নায়ক-নায়িকার সঙ্গে তো এখন এরা পারবে না। ধরেন, আগে ছিলো মান্না। এককালে হিট ছবি করে গেছে। দর্শকের মন জয় করে চলে গেছে, মানুষকে আনন্দ দিয়ে গেছে এরা।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কী ধরনের আনন্দ দিলো এরা?

জাহাঙ্গীর : তার (মান্নার) ছবি লাগালে দর্শক সিনেমাহলে জায়গা পেতো না। সিনেমাহল হাউজফুল। তারপরে আসলো শাকিব খান। ওর ছবিও কিছুদিন চললো বাম্পার। শাকিব লাগালেই ফুলহাউজ। যেকোনো সিনেমাহলে লাগালেই ফুল।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এদের অভিনয় কি দর্শক দেখতো?

জাহাঙ্গীর : তখন দর্শক এদের অভিনয় দেখতো। তারপর আবার চলে গেলো। আস্তে আস্তে ছবি খারাপ করতে লাগলো, দর্শকও নষ্ট হয়ে গেলো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি তো অনেক দিন ধরে এই লাইনে আছেন, নিশ্চয় সিনেমা দেখেন¾সিনেমা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

জাহাঙ্গীর : আমি এখন ছবি দেখি না তো, এই জন্য তেমন কিছু বলতে পারবো না। খুব বেশি হলে শেষের দিকে ১০-১৫ মিনিট দেখি। আগে যখন আমি অলকাতে চাকরি করতাম, তখন খুব ছবি দেখতাম। তখন রাজশাহীর সব কয়টা সিনেমাহলে বই চলতো। আমি সব সিনেমাহলে গিয়েই বই দেখতাম। তখন ছবি দেখার একটা ইমেজ ছিলো। ছবিও ভালো ছিলো; ছবি দেখতেও ভালো লাগতো। ফিল্মটা ভালো লাগতো। ছবির গানগুলা শোনার মতো ছিলো, হিট গান। ডিরেক্টরও ভালো।

আগেকার বইগুলা দর্শক দেখেছে। তারা সিনেমা দেখতে এসে টিকিট পায় নাই। দেখতেই মজা লাগতো তখনকার বই। ধরেন, ময়নামতি¾এই যে গানগুলো বাজতো, শুনতে কী ভালো লাগতো। অবুঝ মন-এর গানও ভালো লাগতো। ছবিও ভালো ছিলো। তারপর দস্যুরাণী, ডাকু মুনসুর¾এগুলা দেখার মতো ছবি। এগুলা দর্শক দেখেছে, আনন্দ পেয়েছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে রাজশাহীতে মোটামুটি চারটা সিনেমাহল ছিলো?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, চারটা সিনেমাহল ছিলো। এখন চারটা সিনেমাহল চালাবে কী করে? এই যে সিনেমা ভালো নাই। ছবি চলছে না। সিনেমাহল মার খেয়ে যাচ্ছে। মালিক লস খাচ্ছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে এখন কী হবে? আপনার কি মনে হচ্ছে, এইভাবে সব সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যাবে?

জাহাঙ্গীর : সব তো আর বন্ধ হবে না, চলবে কিছু। ধরেন, দুই হাজার সিনেমাহল বাংলাদেশে আছে। এক হাজার ভেঙেচুরে বন্ধ করে দিবে। আর এক হাজার টুকটাক করে চলবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন তো মাত্র তিনশো সিনেমাহল আছে বাংলাদেশে।

জাহাঙ্গীর : ওইটাই তো বলছি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার কি মনে হয় এসব বড়ো বড়ো সিনেমাহলের বিকল্প অন্য কোনো ব্যবস্থা হতে পারে? কারণ সিনেমা তো মানুষ দেখছে, নাকি?

জাহাঙ্গীর : অন্য কী ব্যবস্থা হবে? আমি তো বললাম, একটা সমস্যা হয়ে গেছে। মোবাইলে ১০ টাকা দিয়ে তিনটা-চারটা ছবি ভরে নিচ্ছে। যেটা ওর মন চাচ্ছে মোবাইলে ভরে নিচ্ছে, তারপর দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে। সিনেমাহলে সাত দিন চললো বা ১০ দিন চললো বা ২০ দিন চললো, তারপর ছবিটা বাইরে পাওয়া যাচ্ছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সবই বুঝলাম, তাহলে এই সিনেমাহল যদি না চলে, তাহলে তো সিনেমা আর বের করা সম্ভব না। তাহলে কি ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে?

জাহাঙ্গীর : না, সিনেমা চলবে, সিনেমা হবেই। ১০টা থাকলেও সিনেমাহল চলবে। ২০টা থাকলেও সিনেমাহল চলবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : নাকি অন্য কোনো রকমের সিনেমাহল হবে? আপনার কী মনে হয়, এগুলো ভেঙে অন্য কোনো রকমের সিনেমাহল হবে?

জাহাঙ্গীর : আর অন্য ধরনের কী সিনেমাহল হবে?

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে এতো বড়ো জায়গা নিয়ে সিনেমাহলটা। এই এতখানি জায়গা তো দরকার নাই?

জাহাঙ্গীর : না, মালিক যদি মনে করে এই সিনেমাহল ভেঙে চারশো সিট বা পাঁচশো সিটের হল করবে, তো করতে পারে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন এই সিনেমাহলের আসন কতো?

জাহাঙ্গীর : এই ধরেন হাজার পাঁচটা (১,০০৫) বা হাজার ৩৫টা (১,০৩৫), এই রকমই হবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : নতুন কোনো ধরনের সিনেমাহল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না?

জাহাঙ্গীর : এই যে আপনি দেখেন, এতো বড়ো সিনেমাহল, হাজার পাঁচটা বা ২০টা সিট; শুক্রবারে তিনশো-চারশো লোক হচ্ছে। শনিবারে সেই সংখ্যা চলে আসছে একশো জনে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : বৃহস্পতিবারে লোক কেমন হয়?

জাহাঙ্গীর : বৃহস্পতিবারে আসছে ১৫-২০ জন। তো মালিক বাঁচবে কী করে? সিনেমাহলটা চালাবে কী করে? কর্মচারীকে বেতন দিবে কী করে? কারেন্ট বিল দিবে কী করে? এই যে আপনি (সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে লক্ষ্য করে, কারণ উনি ১১ মে ২০১৫ বোঝেনা সে বোঝেনা সিনেমাটি দেখেছে ওই প্রেক্ষাগৃহে) গত সোমবারে বই দেখলেন; কয়টা লোক নিয়ে দেখলেন, বলেন? আপনি নিজেই দেখলেন সিনেমাহলে কয়টা লোক ছিলো। তাইলে আপনি নিজে অনুভব করেন, এতো বড়ো সিনেমাহলে, কয়টা লোক? তাইলে কোম্পানি বাঁচবে কী করে? মালিক বাঁচবে কী করে? আপনাকে রিসার্চ করতে হবে, মাথাতে ঢোকাতে হবে বিষয়টা। এক হাজার সিটের সিনেমাহলে সিনেমা দেখলো ৪-১০টা লোক!

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন প্রশ্ন, তাহলে কী হবে? সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যাবে?

জাহাঙ্গীর : এখন তো ওটা আমি বলতে পারছি না। সিনেমাহল বন্ধ হবে, না চলবে এটা বলা কঠিন।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?

জাহাঙ্গীর : যদি অভিজ্ঞতার কথা বলেন, তাইলে বলবো, কিছু যাবে কিছু থাকবে। তা না হলে দর্শক আনন্দ করবে কীসে? তাই সিনেমাহল না থাকলে তো চলবে না। সিনেমাহল থাকবেই।

ম্যাজিক লণ্ঠন : রাজশাহীতে তো এখন একটাই সিনেমাহল। এভাবে যদি চলতে থাকে, এটা কি থাকবে?

জাহাঙ্গীর : এখন এটা থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি তো টুকটাক সিনেমা দেখেন। তো এখন সিনেমায় যে আইটেম সঙ হচ্ছে, এটা আপনার কাছে কী রকম মনে হয়? ভালো না খারাপ?

জাহাঙ্গীর : আমি তো বললাম, বই ভাঙার (শেষের দিকে) সময় ৫-১০ মিনিট দেখি। আর যদি মন টানে তাইলে সিনেমাহলের ভিতর গিয়ে ১০-১৫ মিনিট দেখি। তাই এ নিয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারছি না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সিনেমাহলে যে নারী দর্শক কমে গেছে, যদি ভালো সিনেমা হয়, নারী দর্শক কি আবার ফিরে আসবে?

জাহাঙ্গীর : হ্যাঁ, আবার যদি ছবি ভালো হয়, তারা দেখবে। ওই যে কী বললাম আপনাকে, ওয়ার্নিং কিছু ছাত্র-ছাত্রীরা তো দেখেছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : জিরো ডিগ্রী কেমন চললো?

জাহাঙ্গীর : জিরো ডিগ্রী ভালো চলেছে। কিছু কিছু ছবি ভালো হচ্ছে, লোকজন সেটা দেখছে। ছাত্র-ছাত্রীরা দেখছে। ফ্যামিলি ধরে অবশ্য লোকজন খুব কম দেখছে। আবার ছবি যদি ভালো হয়, আপার-হাই লেভেলের ফ্যামিলির লোকজন দেখছে। গরিব-দুখিরা এখনকার এই বই দেখে না, এই বই তারা আগে দেখেছে। স্বাধীনতার পরে যে বই চলেছে, সে বই সিনেমাহলে দেখার জায়গা পায়নি মহিলারা। গরিব-দুখি, মা-বোন বই দেখেছে। আপনাকে তো বললাম, ময়নামতি, অবুঝ মন, রাখালবন্ধু¾এই সব বই দেখার জন্য সিনেমাহলে লোকে জায়গা পায় নাই। তখন মা-বোনরা দেখেছে। আমাদের এই সিনেমাহলেই তো জায়গা পায় নাই দর্শক। বেদের মেয়ে জোসনা দেখার জন্য লোকজন ভেঙে বের হয়েছে, সঙ্গে মা-বোনেরাও ছিলো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আবার একটু আপনার নিজের কথায় আসি, তাহলে আপনার পেশা শুরু হলো কী দিয়ে?

জাহাঙ্গীর : আমার বাবা কাঠের কাজ করতো। আমিও কাঠের কাজ করতাম ছোটোবেলাতে। কাঠের কাজ করতাম কিন্তু সিনেমাহল নিয়ে আমার খুব আগ্রহ ছিলো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তখন বয়স কতো আপনার?

জাহাঙ্গীর : এই ধরেন, তখন ১০-১২ বছর হবে। তখন আমি কাজ-কাম করি আর যেদিন বাবার দোকান বন্ধ থাকতো, সেদিন সিনেমা দেখি। শুক্রবার যেমন দোকান ছুটি থাকতো। আর রবিবারে সরকারি ছুটি ছিলো। শুক্রবার আমরা গিয়ে অলকাতে ঢুকতাম সবার আগে। অলকাতে তখন ইংলিশ ছবি হতো। ওখান থেকে সিনেমাহলে ঢোকার আমার খুব শখ ছিলো। তার পর থেকেই ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঢুকে গেলাম।

ম্যাজিক লণ্ঠন : পিয়ন হিসেবে ঢুকে গেলেন?

জাহাঙ্গীর : না, প্রথমে আমি প্রচারে ছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে আমিই সব করতাম।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ওখানে বেতন কতো দিতো?

জাহাঙ্গীর : বেতন মাসে ৯৫ টাকা।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন?

জাহাঙ্গীর : তিন মেয়ে, দুই ছেলে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে?

জাহাঙ্গীর : ছেলে-মেয়ে সবার বিয়ে দিয়ে দিছি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : তাহলে কি এই পেশা দিয়েই জীবন শেষ হবে?

জাহাঙ্গীর : জীবনটা মনে করছি এর ওপর দিয়েই শেষ করে দিবো। তাছাড়া আর কোথায় যাবো বলেন, কী করবো? সিনেমাহলে যারা থাকে, তারা অন্য কাজ করতে পারবে না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কেনো করতে পারবে না অন্য কাজ?

জাহাঙ্গীর : কুঁড়ে (অলস) হয়ে যাবে। আর অন্য কাজ করতে মনও টানবে না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : নাকি সিনেমাহল নিয়ে অন্য ধরনের কোনো ভালোবাসা আছে?

জাহাঙ্গীর : সিনেমাহলে যারা থাকে তাদের অন্য কাজ করতে মন টানবে না। আপনি যদি অন্য কাজে এদেরকে বসান তাইলে ভালো লাগবে না। মনই বসবে না। আমার স্ত্রী বলে, তুমি পান-বিড়ির দোকান করো, ব্যবসা করো। আমি বলি, না, আমার মন টানবে না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মন টানবে না কেনো?

জাহাঙ্গীর : এই যে সিনেমাহল, এই নিয়েই আমি ব্যস্ত। আমার একটা মায়া পড়ে গেছে সিনেমাহলের ওপরে। এই মায়া ছাড়তে পারি না, তাই যেতেও পারি না¾এই হলো ব্যাপার। অন্য জায়গায় ধরেন, আমি যদি নাইটে ডিউটি করি, কমপক্ষে তিন হাজার টাকা বেতন পাবো। রাত ১০টায় যাবো, ভোর ছয়টায় চলে আসবো। এখনো আছে সেই অফার। কিন্তু সিনেমাহলের মায়ার জন্য আমি সেটা করিনি। যখন হল বন্ধ হয়ে যাবে, তখন আমি দেখবো। আমি সিনেমাহলকে খুব ভালোবাসি; সেটা আজ থেকে না, আমি যখন প্রথম হলে গেছিলাম তখন থেকেই।

·        কাজী মামুন হায়দার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।

kmhaiderru@yahoo.com



বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন