Magic Lanthon

               

তাহ্‌সিন আহমেদ

প্রকাশিত ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

বাংলালিংকের দিন বদলে নারী উদ্ধারকল্প

তাহ্‌সিন আহমেদ

ক্রমাগত প্রাযুক্তিক বিকাশের সাথে তাল রেখে চলছে দেশের বহুমুখী গণমাধ্যম। এসব গণমাধ্যমের আধেয়র দিকে লক্ষ্য করলে বিজ্ঞাপনের আধিক্য স্পষ্টতই চোখে পড়ে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো কোমর বেঁধে নেমেছে কে কত বেশি ডলার ব্যয়ে নিজেদের ঢাক-ঢোল পেটাতে পারে তার প্রতিযোগিতায়। এক্ষেত্রে সমাজে বিদ্যমান মূল্যবোধকে নিজেদের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করছেন তারা।কখনও কখনও তা করছেন বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার অন্ধত্বের অনুকরণে। কেননা তাদের একটাই লক্ষ্য মুনাফা। মুনাফার খাতিরেই তারা তৈরি করছেন নতুন নতুন আদর্শ, ঠিক একই কারণে টিকিয়ে রাখতে চাইছেন হাজার বছরের সংস্কার।

বর্তমানে দেশে প্রায় সব ধরনের গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের অনিবার্যতা এবং বাহুল্যতা নিয়ে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে সমাজে বিজ্ঞাপনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব শেষ পর্যন্ত নেতিবাচক কি না? যেহেতু গণমাধ্যমগুলোর মূল আর্থিক সংস্থান বিজ্ঞাপন থেকে আসে, কাজেই বিজ্ঞাপনের এই সর্বব্যাপিতা খুবই স্বাভাবিক| সেই সুযোগে বিজ্ঞাপন হয়েছে অদম্য। যদিও দেশে বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত নীতিমালা রয়েছে, কিন্তু তা সময় উপযোগী করে তৈরি নয় এবং যাওবা আছে তার বাস্তবায়ন নেই। আর এ সব হাজারটা ফাঁকফোকর গলে বিজ্ঞাপন রয়ে গেছে পুরোপুরি জবাবদিহিতামুক্ত। তাই সময়ের তাগিদে একটি যুগোপযোগী ও কার্যকরী নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যাচ্ছে। কিন্তু দশ চড়ে রা করছেন না কেউ ( যারা এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্বে রয়েছেন) । কেননা সবশেষে মাথায় থাকছে নিজেদের লাভবান করার চিন্তা। গণমাধ্যমগুলো প্রভাবিত হচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দ্বারা। আর এর ফলে বিজ্ঞাপন তৈরি করছে নতুন সমাজ বাস্তবতার যা মানবিক সব সম্পর্ককে নিয়ে যাচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতার পর্যায়ে। বিক্রেতারা কেবল পণ্য বিক্রির আকাঙ্খায় অবমূল্যায়ন করছেন বিদ্যমান মূল্যবোধের। আর এক্ষেত্রে তার প্রথম শিকার হচ্ছে নারী। অন্য অনেক কিছুর সাথে নারীকে বিবেচনা করা হচ্ছে কেবল পণ্য বিপণনের উপকরণ হিসেবে।

মুঠোফোন সেবা প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক। এই আলোচনা মূলত তাদের প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে। যেখানে তারা বিয়ের পাত্রী হিসেবে নারীর কিছু গুণের উল্লেখ করেছেন। এবং যে গুণের সমষ্টিতেই নারীকে দেখানোর চেষ্টা করেছেন বিয়ের উপযুক্ত হিসেবে। সব থেকে আশংকার বিষয় এই উপযুক্ততার বিচারে নারীকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে বাংলালিংক সংযোগসহ হ্যান্ডসেটের ১৩৪৯ টাকার মূল্যমানের কাছে। আলোচিত বিজ্ঞাপনটি এমন-

ঘটক তোতা মিয়ার কাছে বন্ধু সমেত বর এসেছেন পাত্রীর খোঁজে। পাত্রী কেমন হবেন, তার কী গুণ থাকতে হবে সে বিষয়ে কথা হচ্ছে।

ঘটক তোতা মিয়া: বাহ (তালি) একদম রেডি হয়ে ঠিক জায়গায় আসছেন। বলেন, কী ধরনের মেয়ে চান?

বর: আমি তো একটু লাজুক ওই বলুক (বন্ধুর উদ্দেশে) ।

বরের বন্ধু: নাহ... তেমন কিছু চান না। Just এমন একটা মেয়ে চান, যে পুরো ঘর আলো করে রাখবে, (বরের লাজুক হাসি) হিসাব নিকাশে পটু, সব ধরনের গান-বাজনা পারে, দিন দুনিয়ার সব খবর বলতে পারবে, সবার সাথে যোগাযোগ রাখবে, ঘন্টার পর ঘন্টা মন খুলে কথা বলা যাবে।

ঘটক তোতা মিয়া: (বরের বন্ধুর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়) আপনার শেষ হইছে। ভাইজান (বরের উদ্দেশে) আমার তো মনে হয় আপনার মেয়ের দরকার নাই। (বরের মুখের বিকৃতি) আপনার দরকার এই বাংলালিংক হ্যান্ডসেট (সামনে একটি মোবাইল বাড়িয়ে দিয়ে) । এটা ঘর আলো করে রাখবে, গান শুনাবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যাবে। যা যা চাইবেন সব পাইবেন। আজকাল তো বিয়ে করতে অনেক খরচ। বাংলালিংক হ্যান্ডসেট সংযোগসহ পাবেন মাত্র ১৩৪৯ টাকায়।

জিঙ্গেল: বাংলালিংক হ্যান্ডসেট রূপে গুণে অনন্যা। আমি ধরেই নিচ্ছি বিজ্ঞাপন চিত্রটি আপনারা দেখেছেন এবং তা মোটেও একবার নয়। বিজ্ঞাপনটি হয়ত অনেকের ভালোও লেগেছে। বারবার টিভি পর্দায় একই বিজ্ঞাপন দেখে হয়ত বিরক্তও হয়েছেন অনেকে। বিজ্ঞাপনটিতে নারীকে উপযুক্ত পাত্রী হওয়ার জন্য যে সব গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে সেগুলোকে নির্দিষ্ট করলে দাঁড়ায় এমন-

     ১. যে পুরো ঘর আলো করে রাখবে। অর্থাৎ মেয়েটিকে সুন্দরী হতে হবে।

     ২. হিসাব নিকাশে পটু। তার মানে সংসার সামলানোর দায় নারীর, পাত্রী হিসেবে এটা তার অন্যতম গুণ।

     ৩. সব ধরনের গান-বাজনা পারে। নারী মনোরঞ্জনকারী, গানে নাচে তার পারদর্শিতা জরুরি।

     ৪. দিন দুনিয়ার সব খবর বলতে পারবে। অর্থাৎ নারীরা দিন দুনিয়ার খবর রাখে না।

     ৫. সবার সাথে যোগাযোগ রাখবে।তার মানে সংসারের সবার মন জুগিয়ে চলতে হবে।

     ৬. ঘন্টার পর ঘন্টা মন খুলে কথা বলা যাবে। অর্থাৎ তার ইমেজ অনেকখানি যান্ত্রিক। কোন আবেগ অনুভূতি থাকবে না, অন্যের ইচ্ছাই তার আচরণ নির্ধারণ করবে।

একটু ভাবলেই বোঝা যায়, বিজ্ঞাপনের আবরণে এখানে নারীকে বিশেষায়িত করা হয়েছে পুরুষের আকাঙ্খার বস্তু হিসেবে। পুরুষ প্রাধান্যশীল সমাজের ছকে আঁকা নারীর এই গুণাবলীকে এবার একটু গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক।

পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর সৌন্দর্যের বয়ান

ভারতীয় উপমহাদেশে আদিবাসীদের সভ্য করতে সর্বপ্রথম আর্যরা শাসন ভারের দায়িত্ব তুলে নেন। নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে সভ্যতার অপরিহার্যতায় রূপান্তর করতেই অন্য অনেক বিশ্বাসের সাথে আদিবাসীদের মধ্যে থিতু করেন সুন্দর নারী মানেই তার রঙ হবে ফর্সা। ঘর আলো করার সাথে সৌন্দর্যের এই গুণ সম্পর্কিত। সাধারণত কনে হিসেবে নারীর কাছে পুরুষের প্রথম যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে তা হলো তার ফর্সা গায়ের রঙ। কেবল ফর্সা হলেই হবে না, সঙ্গে থাকতে হবে স্লিম দেহ, মাঝারি উচ্চতা। ফলে ফর্সা-কালো, স্লিম-স্থূল, বেটে-মাঝারি কিংবা লম্বা এই রূপরেখায় সমাজে বিয়ের পাত্রী হিসেবে মূল্যায়িত করা হচ্ছে নারীকে, মানুষ হিসেবে নয়।

অর্থাৎ নারী যেন কোরবানীর পশু; হাটের সব থেকে রঙরঙা, সুস্থ-সবল পশু না কিনলে পুরুষ-গেরস্থর যেমন মান থাকে না! তেমনি স্ত্রী যদি বেটে, কালো হয় তাহলেও মান থাকে না পুরুষের। আর পুরুষের এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মেয়ের মা-বাবা তার বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। খোঁজেন উত্তরণের উপায়। আর মেয়ের মা-বাবার এই দুশ্চিন্তাকে উপজীব্য করে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো একজোট হয় ব্যবসা বাড়ায়। ত্বকে অতিরিক্ত মেলানিনের জন্যই ত্বক কালো হয়। রঙ ফর্সাকারী ক্রিম এই মেলানিন দূর করতে না পারলেও বিজ্ঞাপনে এর বিপরীত কথাই বলে। আর এ মিথ্যা আশ্বাসেই নারী সৌন্দর্যের অপরিহার্যতায় রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ধরে রাখে পণ্যের বাজার। বিদ্যমান সমাজের এই সাধারণ দর্শন অনুসরণ করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখে নিজেদের; একই সাথে সাধারণের মনে শাসকশ্রেণীর রুচি ও দর্শন। চিন্তাটা যখন মুনাফার সেখানে কে মূল্যায়িত আর কে অবমূল্যায়িত হলেন তা দেখার সময় নেই তাদের।

আর নারীকে তো তারা পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেই ফেলেছেন। সেক্ষেত্রে তাদের কিভাবে উপস্থাপণ করা হলো না হলো সেটা নিয়ে না ভাবলেও চলে। বাংলালিংকও অন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের মতই নারীর উপস্থাপন নিয়ে ভাবে নি। উপযুক্ত পাত্রীর অপরিহার্য গুণ হিসেবে আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছে ফর্সা রঙের কথা। অন্যদিকে একই সাথে স্বার্থ রক্ষা করেছে রঙ ফর্সাকারী ক্রিম কোম্পানি, তাদের জাত ভাইদের।

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে

পুরানো দিনের এই জনপ্রিয় গানটা দিয়ে শুরু করছি। গানটা পুরুষের চোখে নারীকে দেখার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পুরুষ-শাসিত সমাজে নারীকে এভাবেই চিন্তা করা হয়। সংসারের গণ্ডির মধ্যে রেখে নারীকে দিয়ে দেয়া হয় সাংসারিক দায়বোধ। নারীর টাকা রোজগারের কোন ক্ষমতা নেই- এ দোহাই দিয়ে পুরুষ যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্ম থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। আর যেহেতু নারীর টাকা রোজগারের ক্ষমতা নেই, তাই তাকে দেওয়া হয় যাবতীয় হিসাব নিকাশ রাখার দায়িত্ব। অন্যদিকে স্বামী তার কাছ থেকে সেই খরচের পাই পাই হিসাব নিয়ে সংসারে তার প্রভুত্ব জাহির করেন। যদিও বর্তমানে নারী সম্পর্কে এই গৎবাধা ধারণার ইতি ঘটেছে।পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে কর্মক্ষেত্রে আজ নারী প্রায় সমঅবস্থানে। বিজ্ঞাপনে নারী-পুরুষের এই পাশাপাশি থেকে কাজ করার বিষয়টিও উঠে এসেছে। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক গ্রামীণফোনের একটি বিজ্ঞাপনের কথা বলতে পারি। এতে দেখানো হয় স্ত্রী (সুমি) মন ভুলো স্বামী (শাহেদ) অফিস যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতে তুলে দিচ্ছেন।এটা দেখে মনে হয় এটা প্রতিদিনের ঘটনা। বিজ্ঞাপনের পরের দৃশ্যে আমরা দেখি সুমি গ্রামীনফোন কাস্টমার কেয়ারের ব্যবস্থাপক।

এটা খুব স্বাভাবিক স্বামীকে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের কথা স্ত্রী মনে করিয়ে দেবেন, আবার এর বিপরীতটাও ঘটবে। কিন্তু ওই বিজ্ঞাপনের টেক্সট যা হাজির করে তাতে বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্ট। অর্থাৎ পুরুষ ভুলে যাবে, নারী তাকে মনে করিয়ে দেবে। এটা তার কাজ। একই সঙ্গে শুধু এই কাজই নয়, সে বাইরেও সফলতার সঙ্গে কাজ করবে। পরিস্কার করে বললে বিষয়টা এমন দাঁড়ায়, সময়ের পরিবর্তনে নারী পুরুষের সমঅবস্থানে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন; কিন্তু সহঅবস্থান হলেও ঘর-সংসার সামলানোর দায় কেবল নারীরই, ওটা পুরুষের নয়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক মনোভাব থেকে এখনও চোখে আঙুল দিয়ে কিন্তু সেটাই দেখাচ্ছেন। কারণ শেষ পর্যন্ত নারীর কাছে পুরুষের এমনটাই আশা। তাইতো হিসেব নিকাশে কাঁচা পাত্রী উপযুক্ত নয়। 

নারী কেবলই মনোরঞ্জনকারী, বিনোদিনী

একথা শোনামাত্র প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের চিত্র চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যে সময়টাতে রাজা আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা বালিশে ঠেস দিয়ে বসে থাকতেন, হাতে থাকত মদের পেয়ালা। তাদের সামনে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে নাচ-গান করত বাইজিরা। তখন ভোগ্য উপাদানের বাইরে নারীকে অন্যকিছু ভাবার অবকাশই ছিল না। একই অবস্থা ছিল বৈদিক উপনিষদের যুগেও। সেখানে নারীকে উল্লেখ করা হয়েছে ভোগ্য, পণ্য, ব্যবহার্য বলে।    সামন্ত যুগ শেষ হয়েছে সেই কবে, কিন্তু নারীর সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এখনও নারী মানে গান-বাজনা জানতেই হবে।

কিন্তু সেটা পুরুষের ক্ষেত্রে কেনো নয়? পাত্র হিসেবে পুরুষের গান-বাজনা জানতে হবে এমনি কেউ বলে না। কারণ পুরুষ ভোগী আর নারী ভোগ্য। আবহমানকাল ধরে সমাজে নারীর অবস্থানের এই রূপ থেকে বেরোতে পারেনি বাংলালিংক।

ষোল কলার এক কলা(-) দিন দুনিয়ার খবর রাখা

বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতার নিরিখে বলা যায়, একটা সময় ছিল যখন নারীরা ঘরের বাইরে বের হতে পারত না। নিজের সংসারের বাইরে কোন বিষয় সম্পর্কে নারীর জানতে চাওয়ার আকাঙ্খা তখন অবদমিত ছিল। আর সেটাও করেছিল এই পুরুষই। তখন ধোঁয়া তোলা হয়েছিল পর্দার। দীর্ঘদিন নারী সেটা মেনেও নিয়েছিল। এক পর্যায়ে অবস্থার পরিবর্তন হলো, নারীরা বাইরেও আসলো; কিন্তু সেই বাইরে আসার ধরনও নির্ধারণ করে দিল সেই পুরুষই। আর সেই নির্ধারণের মধ্যে বলা হলো, শুধু বাইরে আসলেই চলবে না, তোমাকে সব খবর রাখতে হবে।

একই সঙ্গে নারীর বাইরে উপস্থাপন নির্ধারিত হলো পুঁজির জটিল হিসেবে। বর্তমানে এই সব হিসাব ভেঙ্গে নারী বাইরে এসে সব বিষয়ে কিন্তু তার প্রয়োজনেই খবর রাখছে, তারপরও পুরুষের সেই অধস্তন বাণী, তাকে দিন দুনিয়ার খবর রাখতে হবে। কারণ আবারও পুরুষ নারীকে স্মরণ করে দিতে চায় সন্তান লালন-পালন তোমার কাজ; এ কাজে সফল হতে হলে তোমাকে জানতে হবে অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস, সংস্কৃতিসহ তাবৎ বিষয়। বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন চিত্রে কনের চতুর্থ গুণ অন্তত এমন ইতিহাসই পুনঃনির্মাণ করতে চেয়েছে। 

 নারীর নিজের জন্য কিছু নেই

আমাদের সমাজে জন্মের পর মা-বাবা তাদের কন্যা শিশুকে একজন মেয়ে হিসেবে গড়ে তোলা শুরু করে। তুমি মেয়ে তোমাকে ধীর-স্থির, বিনয়ী ও নমনীয় হতে হবে। এভাবে জন্মের পর থেকেই একজন নারীকে পুরুষতন্ত্রের জালে আটকানো শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় বিয়ের পর সংসারের যাবতীয় যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয় তার কাঁধে। বাড়িতে কে এলো-গেলো, কে খেয়েছে বা খায়নি, সংসারে কার কী প্রয়োজন ইত্যাদি সব কিছু তার নখদর্পণে রাখতে হবে। সেটা তার ভাল লাগুক, আর নাই লাগুক। কিন্তু তার খাওয়া না খাওয়ার খবর নেয় না কেউ। আবার সবার মন জুগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসলেই সেই নারীরই মাথা লুকাবার কোন জায়গা থাকে না।তখন সবাই খুঁজতে থাকে তার যত দোষ।

নারী যন্ত্র, রক্ত মাংসে মানুষ নয়

পুরুষ নিয়ন্ত্রিত এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে ধরা হয়ে থাকে পুরুষের অর্ধাঙ্গী রূপে। পূর্ণাঙ্গতার বিচারে তাকে কখনও দেখা হয় নি। নারী নিজে অস্তিত্বহীন। একমাত্র পুরুষের সংস্পর্শে নারী মূল্যায়িত, বিশেষিত হয়। তার নিজের কোন ইচ্ছা, আবেগ-অনুভূতি কিংবা পরিবর্তিত মানসিক চিন্তা থাকবে না-এমনটাই যেন স্বাভাবিক|

তার আবেগ-আকাঙ্খা কিংবা মানসিক পরিবর্তন অন্যের দ্বারা (বিশেষ করে স্বামীর) পরিবর্তিত হবে। তার সাথে সম্পর্কিত সবার মানসিক ইচ্ছার দাম দিয়ে চলতে হবে তাকে। বাংলালিংক বিজ্ঞাপনটিও এটাই স্পষ্ট করতে চেয়েছে। বিয়ের পাত্রীর যোগ্যতা নির্ধারণ করা সর্বশেষ বৈশিষ্ট্যে, নারীকে মানসিকভাবে সম্ভোগ এর চিত্রকল্প উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেখানে পাত্রীর অন্যতম গুণ হিসেবে বলা হয়েছে, তার সাথে ২৪ ঘন্টা মন খুলে কথা বলা গেলে, তবেই সে বিয়ের উপযুক্ত, অন্যথায় নয়। আধুনিক যুগে দিন বদল করতে চায় যারা তাদের দর্শন আর প্রাচীন ভারতীয় দর্শন এখানে মিশে একাকার। প্রাচীন ভারতের নারীদের অবস্থা সম্পর্কে সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন'...স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নারীর মন বলে কিছু আছে একথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে।২ বাংলালিংকও তাদের বিজ্ঞাপনে পশ্চাৎপদ সমাজের এই চিন্তাকেই তুলে ধরেছে, ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে প্রাচীন সমাজ দর্শন। এটা তো রীতিমত দিন বদলেরই চেষ্টা(!), নাকি? পাঠক, এখানেই শেষ নয়। তারা থেমে থাকতে চাননি প্রাচীন ভারতীয় কিংবা বিদ্যমান সমাজে নারীকেন্দ্রিক ভাবনায়। নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে তাই হাঁকিয়েছেন তার বাজার দরও।

অনেকটা নিলামে তোলার মতো নারীর সাথে বাংলালিংক সংযোগসহ হ্যান্ডসেটের দর কষেছেন। রীতিমত শংকায় ফেলে দিয়েছেন দর্শককে। তাহলে কি নারীর বাজার দর বাংলালিংক হ্যান্ডসেটের সাথে তুলনীয়? নাকি ওই বিশেষ হ্যান্ডসেটের কাছে নারীর পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে গেছে? বিজ্ঞাপনের টেক্সট যা বলে, তাতে মনে হয় মাত্র ১৩৪৯ টাকার হ্যান্ডসেটের চেয়ে নারী (বিয়ের পাত্রী) কম গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ের উপযুক্ততার বিচারে নারীর থেকে ওই হ্যান্ডসেটটাই আকাঙ্খিত আপনি একজন নারীর মধ্যে যে গুণগুলো খোঁজেন, তার চেয়ে বেশি গুণসম্পন্ন বাংলালিংক হ্যান্ডসেট। আবার নারীর যে গুণ রয়েছে তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞাপনটি সব সংশয়ের উপরে রেখেছে হ্যান্ডসেটকে। অর্থাৎ বাংলালিংক তার হ্যান্ডসেটের পণ্য-গুণ নারী অপেক্ষা উঁচুমানের হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিয়ের সমস্যা হিসেবে আপনার সামনে খরচকে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই তুলনায় ১৩৪৯ টাকা দিয়ে একটি বাংলালিংক হ্যান্ডসেট ক্রয়কে আপনার জন্য অনেক লাভের বস্তু হিসেবে তুলে ধরেছে। আর মুনাফা অর্জনের স্বার্থে টিকিয়ে রেখেছে বিদ্যমান সমাজের নারীর প্রতি মূল্যবোধকে। বাহ! নারীকে মূল্যায়নের কী আসাধারণ সূচক তৈরি করেছে বাংলালিংক। এই যখন অবস্থা, তখন প্রশ্ন তারা কিসের দিন বদলের কথা বলছেন। এই দিন বদল মানে কী তাহলে পশ্চাৎমুখীনতা! যার জন্য প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির আদলে নারীর এই গৎবাধা চিত্রায়ণ। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না যে, দিন বদল নয়, বাংলালিংক পুরুষতন্ত্রের চরম প্রতিক্রিয়াশীল দিন ফিরিয়ে আনারই চেষ্টা করেছে! অন্তত আলোচিত বিজ্ঞাপনটি তাই বলে !

লেখক : তাহ্‌সিন আহমেদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।

তথ্যসূত্র

১. লীনা, চাকী (২০০১:৬৫); বাউলের চরণদাসী; পুস্তক বিপণী, কলিকাতা।

২. উদ্ধৃত, ভট্টাচার্য; লীনা, চাকী (২০০১:৬৫); বাউলের চরণদাসী; পুস্তক বিপণী, কলিকাতা।

সহায়ক গ্রন্থ

১. আহমেদ, মুসতাক (২০০২); বাংলাদেশে টেলিভিশনের প্রাইম-টাইম বিজ্ঞাপনে নারীর রূপায়ণ; নাসরীন, গীতি আরা এবং প্রমুখ (সম্পাদিত); গণমাধ্যম ও জনসমাজ; শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা।

২.শুভ, শাতিল সিরাজ (১৯৯৯); সমাজে বিজ্ঞাপনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কিত কিছু টেক্সটের পর্যালোচনা; Adcomso Journal; 5th issue; January-December, 1999.

৩.গায়েন, কাবেরী (২০০২); বিবাহ বিজ্ঞাপনের সমাজতত্ত্ব: চারটিÑঢাকা- দৈনিকের পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনের লৈঙ্গিক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ; যোগাযোগ; সংখ্যা-০৪, মার্চ ২০০২।

৪.হক, ফাহমিদুল (২০১১); অসম্মতি উৎপাদন: গণমাধ্যম বিষয়ক প্রতিভাবনা; সংহতি প্রকাশন, ঢাকা।

৫.ইসলাম, উদিসা (২০০৫); ধর্ষণ-সংবাদে লিঙ্গীয়-দৃষ্টিভঙ্গির বিচারমূলক পাঠ; যোগাযোগ; সংখ্যা-০৭, ফেব্রুয়ারি ২০০৫।

৬.চক্রবর্তী, সুস্মিতা (২০০৫); প্রথম আলোর নকশা’ পাতায় নারী-সংবাদ উপস্থাপন ও প্রদর্শনের রাজনীতি; যোগাযোগ; সংখ্যা-০৭, ফেব্র“য়ারি ২০০৫।

৭.চাকী, লীনা (২০০১); বাউলের চরণদাসী; পুস্তক বিপণী, কলিকাতা।

৮.পার্থ, পাভেল; কর্পোরেট ঘের বন্দী গণমাধ্যম; মাধ্যম; ১ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, ফাল্গুন ১৪১৬।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন