Magic Lanthon

               

ইমরান হোসেন মিলন

প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ডিসকোর্সে বাঁধা মুক্তিযুদ্ধ, নায়ক যেখানে চাষী

ইমরান হোসেন মিলন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ঢাকার শাহবাগের রাস্তা দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। শাহবাগ মোড়ে রাস্তার পাশে মানুষের জটলা দেখে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দেন তিনি। গাড়ি থামলে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হচ্ছে?’ তখন চাষী নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর দিকে এগিয়ে এসে বলেন, ‘সিনেমার শুটিং হচ্ছে।’ ‘ভালো, কোনো অসুবিধা আছে নাকি?’ ‘জানতে চান বঙ্গবন্ধু। চাষীর উত্তর ছিলো, ‘টাকা নাই।’ বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘হবে হবে, সব হবে ...।’

সেটা ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের কথা। একসময় ওই শুটিং শেষ হয়, শেষ হয় পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ, আর সবশেষে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিও পায় চলচ্চিত্রটি। দর্শকের অভাবিত সাড়া মেলে। নন্দিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন। মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র-নির্মাণের সেই সূচনা। একই সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু মুক্তিযুদ্ধের ভিজ্যুয়াল ইতিহাস নির্মাণের। আর নির্মাতারাও মত্ত হন গুরুত্বপূর্ণ এ অর্জনের নানা দিক নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। মুক্তিযুদ্ধের গ্রান্ড ন্যারেটিভ নির্মাণে অন্যতম শক্তিশালী চর্চার মাধ্যম হয়ে ওঠে চলচ্চিত্র।

কথা হচ্ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে। ইতিহাস কিন্তু সবাই রচনা বা ব্যাখ্যা করতে পারে না। ইতিহাসের যেমন ভাববাদী ব্যাখ্যা আছে, তেমনই আছে বস্তুবাদী বা দার্শনিক ব্যাখ্যাও। তবে দার্শনিক ব্যাখ্যাটাই এখন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। যেখানে ভলতেয়ার, হারডার, কনডরসেট, মন্টেসক্যু আর প্রধান হিসেবে যার নাম আসে তিনি হেরোডোটাস; যিনি এর জনক বলে পরিচিত। তবে সে ইতিহাসের ব্যাখ্যাও এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।

উপমহাদেশের ইতিহাস ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হয়েছে। যখন যে শাসক ক্ষমতায় এসেছে তার হাতেই লেখা হয়েছে সেই ইতিহাস। সর্বশেষ সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হলে উপমহাদেশে নতুন এক ইতিহাস লেখা শুরু হয় তাদের হাত ধরে। ইংরেজদের পরেও ক্ষমতার পালাবদলে ইতিহাস রচনা ও তার ব্যাখার পরিধি বদলেছে। কিন্তু ধারার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার সময়েও ইতিহাসের সেই ধারা অপরিবর্তিতই ছিলো। তাই বৃহৎ অর্থে এই ইতিহাস নিয়ে কোনো ‘বিতর্ক’ ছিলো না। বিতর্ক বলতে এখানে বোঝাতে চাইছি রচিত ইতিহাসে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি যা মূলত একরৈখিক। যে কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মন্টেসক্যু আর হেরোডোটাসদের বাইরে যেতে পারেনি। তবে ইতিহাসের এই আদিকল্প নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তোলেননি এমন নয়।

সাম্প্রতিককালে ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ‘সাবলটার্ন’ শ্রেণীর ধারণাটিকে নতুনভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। রণজিৎ গুহ এর বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন ‘নিম্নবর্গ’। সাবলটার্ন স্টাডিজ প্রবন্ধ সংকলনগুলিতে এবং জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, রণজিৎ গুহ, শাহিদ আমিন প্রমুখ ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে এই ধারণাটি ব্যবহৃত হয়েছে। গ্রামশির ইঙ্গিতগুলিকে অনুসরণ করেই ‘নিম্নবর্গ’ ধারণাটির উদ্ভব। আর প্রচলিত ইতিহাস নিয়ে এই প্রশ্ন ওঠে ১৯৮০’র দশকে, যখন রণজিৎ গুহরা নতুন করে ওই ‘ইতিহাস’ রচনা শুরু করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলছিলাম। যা সব মাধ্যমেই কমবেশি উঠে এসেছে। চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাতা হিসেবে ওরা ১১ জন দিয়ে তার ইতিহাস ধারণের চেষ্টা শুরু করেন। তার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে সংগ্রাম (১৯৭৪), হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৯৭), মেঘের পরে মেঘ (২০০৪) ও ধ্রুবতারা (২০০৬); এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন চাষী। এগুলোর মধ্যে ওরা ১১ জন, হাঙ্গর নদী গ্রেনেডমেঘের পরে মেঘ নিয়ে এখানে কথা বলবো। এই আলোচনায় খুব ছোটো করে চাষী নির্মিত এ তিনটি চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দেখার চেষ্টা থাকবে।

চলচ্চিত্র মাধ্যমে চাষী যখন প্রথম যোদ্ধা

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি আমাদের ছেড়ে চলে যান নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। সেদিনকার বিবিসি বাংলার খবরের শিরোনাম ছিলো¾‘চলে গেলেন ওরা ১১ জন-এর চাষী নজরুল ইসলাম’। এছাড়াও বেশকিছু গণমাধ্যমে সেদিনের শিরোনাম ছিলো বিবিসি’র আদলেই। সেগুলোতেও চাষী নজরুলকে ওরা ১১ জন পরিচালক খ্যাতি দেওয়া হয়েছে। তাই এটা বুঝতে কষ্ট হয় না, চাষী নজরুলকে দেশের মানুষ ওরা ১১ জন দিয়েই চেনেন।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কেনো দর্শক ওরা ১১ জন দিয়েই তাকে চেনে? মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চলচ্চিত্র সেটি, শুধু এই জন্যই কী? তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তাহলে সেগুলোকে কেউ ‘আদর্শ’ ধরে না কেনো, কেনো সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয় না¾সেটাও মনে প্রশ্ন জাগায়। তার অন্য চলচ্চিত্রগুলোতে এমন কী নেই, যা চাষীকে ঠেলে দেয় শুধু ওরা ১১ জন নির্মাতার পরিচয়ের দিকে?

মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ধারার যাত্রা, বাণিজ্য যেখানে উদ্দেশ্য

মুক্তিযুদ্ধকে অবলম্বন করে দেশে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও আছে। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হয়েছে; যে যার মতো অবস্থান নিয়েছেন। তবে চাষীর দেখানো পথে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে অনেকেই যে একেবারে ‘বিপথে’ চলে গেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের চলচ্চিত্রের মধ্যে

সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২), মমতাজ আলীর রক্তাক্ত বাংলা (১৯৭২), আনন্দের বাঘা বাঙ্গালী (১৯৭২), আলমগীর কবিরের ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), কবীর আনোয়ারের স্লোগান (১৯৭৩), আলমগীর কুমকুমের আমার জন্মভূমি (১৯৭৩), খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩), চাষী নজরুলের সংগ্রাম (১৯৭৪), মিতার আলোর মিছিল (১৯৭৪), এম আলীর বাংলার ২৪ বছর (১৯৭৪), আনন্দের কার হাসি কে হাসে (১৯৭৪), নিয়াজ ইকবালের আজও ভুলিনি (১৯৭৫), হারুনুর রশিদের মেঘের অনেক রং (১৯৭৬) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব দাবি করা হলেও উল্লিখিত চলচ্চিত্রের একটা ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে যুদ্ধকেন্দ্রিক সচেতন সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।

তবে সেসময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমনও কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে, যেগুলোতে যুদ্ধের চেয়ে ব্যবসায়িক মনোভাবের প্রভাব স্পষ্ট। এমনও হয়েছে চিত্রনাট্যের কোনো আগামাথা না রেখে, শুধু পাকসেনাদের হাতে নারী ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে তুলে আনা হয়েছে। এই ঘরানার ‘অধিকাংশের মধ্যে ছিল নির্মাতাদের মুনাফা অর্জনে কুরুচিপূর্ণ মনোভাব।

সবাই যখন একাধারে বাণিজ্যিক ‘মসলা-মার্কা’ মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র-নির্মাণ শুরু করলেন, তখন অবস্থা বেগতিক হয়ে যায়। আর এসব দেখে নির্মাতা আলমগীর কবির বলেছিলেন, ‘প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলাম যে, পাকিস্তানি হার্মাদ কর্তৃক আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণের চলচ্চিত্রায়ণের মধ্যে বিরাট বাজারি সম্ভাবনা রয়ে গেছে।’ যে বাজারি সম্ভাবনার দেখা পেয়েছেন অনেক নির্মাতা। চাষী যে বাজারি সম্ভাবনার শুরু করেননি তা নয়। ওরা ১১ জন দিয়েই মূলত ওই বাজারি সম্ভাবনা হয়তো দেখেছিলেন পরের দিকের নির্মাতারা।

চাষী তার ওরা ১১ জন-এ দেখালেন ধর্ষণের ঘটনা। চলচ্চিত্রটি শুরুর ২৫ মিনিটে অপরিচিত এক নারীকে তুলে নেওয়া থেকে শুরু করে কেয়া (৪২ মিনিটে), মিতা (৫১ মিনিটে) এবং সর্বশেষ ভাই পারভেজের সামনে শিলার (৬২ মিনিটে) ধর্ষণ হতে দেখান চাষী। প্রতিবারেই পাকসেনাদের ধর্ষণদৃশ্য এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা দর্শককে একধরনের বিকৃত আনন্দ দেয়। চাষী যেভাবে একই বিষয়কে এতবার দেখালেন, সেটা কি শুধুই ইতিহাস তুলে ধরার জন্য? উল্টোভাবে বললে, ধর্ষণ বোঝানোর জন্য কি নারী-পুরুষের ওই ধরনের উপস্থাপন খুবই জরুরি?

মেঘের পরে মেঘ-এ মাজিদের অল্পবয়সী বোন লুৎফাকে ধর্ষণ করে পাকবাহিনী। সেখানে পাকিদের সঙ্গে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ নেয় রাজাকার চুনি ও তার দলবল। আবার কোনো সামঞ্জস্য না রেখেই চলচ্চিত্রটিতে হঠাৎ করেই চাষী জোছনা রাতে নায়ক-নায়িকার প্রেম, গান দেখান! আর হাঙ্গর নদী গ্রেনেড-এ ধর্ষণদৃশ্য আর গান না থাকলেও আছে রাজাকার মনসুরের হাস্যকর উপস্থাপন। ওরা ১১ জন-এও বেশ সময় নিয়ে রাজাকারদের তিনি হাজির করেন হাসির উপকরণ হিসেবে; একইভাবে মেঘের পরে মেঘ-এ রাজাকার চুনিকে দিয়েও দর্শকদের হাসিয়েছেন চাষী। প্রথম প্রশ্ন, ভয়ঙ্কর রাজাকারদের এই হাস্যকর উপস্থাপন কি চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে ছিলো, নাকি অন্য কিছু? রাজাকারের এই উপস্থাপন হয়তো আপাত দর্শকের হাসির খোরাক জোগায়। কিন্তু বৃহৎ অর্থে তা রাজাকারদের ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডকে অনেকক্ষেত্রে হালকা করে ফেলে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ ও এতো মানুষের বিসর্জন নিয়ে যারা এখনো প্রশ্ন তোলেন, তারা কিন্তু এতে সুযোগ পেয়ে যায়।

আর চাষী নজরুলের দেখানো পথে বাজারি সম্ভাবনার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায় ৮০’র দশকে। তখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নাম নিয়ে মুক্তি পেয়েছে, অথচ সেগুলো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ও ‘মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র’র তালিকা দীর্ঘায়িত করা ব্যতীত আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কোনোরূপ উজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে পারেনি।’ এমনও হয়েছে সরকারি অনুদান নিয়ে অনেক নির্মাতার সেসময় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে হাতেখড়ি হয়েছে এবং এর মাধ্যমেই নাকি তারা নির্মাতা হয়ে উঠতে ‘হাত পাকিয়েছেন’! বিশেষ কোনো শব্দ ব্যবহার না করেই অন্তত এটুকু বোঝা কঠিন নয় যে, সেই ‘হাত পাকানো’ চলচ্চিত্রগুলোই বাণিজ্যিক আকার লাভ করেছিলো।

১৯৭২ থেকে ২০০৪, মানসিকতার পরিবর্তন নেই

গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে খসরু ও তার বোন ঢাকায় থেকে পড়ালেখা করেন। খসরু হোস্টেলে থাকলেও, মেডিকেল কলেজে পড়া বোন মিতা থাকেন মামার বাড়িতে। বলা যায়, মামা বাড়িতে মিতাদের আরেকটি শহুরে ছোটো সংসার। অন্যদিকে মিতার বান্ধবী শিলার বাবা সরকারি চাকরিজীবী, বড়ো ভাই পারভেজও চাকরিতে ঢুকেছেন আর ছোটো ভাই করেন পড়াশোনা।

দুই পরিবারের সবাই রাজনীতি সচেতন এবং দেশাত্ববোধে উজ্জীবিত। সবসময় দেশের খবর রাখার পাশাপাশি অংশ নেন নানা আন্দোলন সংগ্রামে। তবে এদিক থেকে সবচেয়ে সচেতন বলা যায় খসরুকে। তার শহুরে ও গ্রামের বন্ধুরা সবাই দেশের ব্যাপারে খুবই সচেতন। মিটিং-মিছিল, নিজেদের মধ্যে আলোচনা সবই করেন তারা। আলোচনা হয় শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক নিয়েও। একসময় শুরু হয় ২৫ মার্চের কালরাত।

চাষী নজরুল তার ওরা ১১ জন-এ দেখালেন শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চ রাতে পাকসেনাদের অতর্কিত ঢাকা আক্রমণ, তাদের নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতনের চিত্র। তুলে ধরলেন পাকিস্তানি মিলিটারি, রাজাকার-আলবদর কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণের চিত্র। নির্বিচারে মানুষ হত্যার দৃশ্য।

পরে দেখালেন কিছু তরুণের যুদ্ধে অংশগ্রহণ, সবকিছুকে তুচ্ছ করে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার দৃঢ় মানসিকতা। সবশেষে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়া, বীরাঙ্গনাদের ঘরে ফেরা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়োল্লাস, হাতে স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের পথে নেমে আসা।

চাষী নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাই তার চলচ্চিত্রে অনেক কিছুই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরা। এছাড়া চলচ্চিত্রটির আরো একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, যারা যোদ্ধা হিসেবে অভিনয় করেছেন তাদের অনেকে সত্যিই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ কারণে চলচ্চিত্রটি নিয়ে একটি আলাদা আবেগ কাজ করে। তাই বলে চাষী যা তুলে ধরলেন তার সবই কি অকাট্য সত্য?

চাষী বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন হাঙ্গর নদী গ্রেনেড। চলচ্চিত্রটিতে যুদ্ধের চেয়ে সামাজিক জীবনের গল্পই বেশি উঠে এসেছে; সঙ্গে যুদ্ধপূর্ব গ্রামীণ সমাজের অবস্থা ও যুদ্ধকালীন সমাজবাস্তবতা। চাষী একটু ভিন্নভাবে এখানে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে আনলেন। দেখালেন গ্রামীণ জীবনে যুদ্ধের রেশ এবং অল্পস্বল্প শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের যুদ্ধে অংশগ্রহণ আর তাদের আত্মত্যাগের চিত্র।

তিন ছেলে¾ছলিম, কলিম আর প্রতিবন্ধী রইছকে নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে বসবাসরত কৃষক পরিবারের এক মায়ের কাহিনি হাঙ্গর নদী গ্রেনেড। সেখানে প্রকাশ পেয়েছে গ্রামীণ নারীর দেশের প্রতি ভালোবাসা। যুদ্ধে যাওয়া ছেলেকে দেশের জন্য বিসর্জন দেন মা। এখানেও আছে দাড়ি-টুপি পরা মনসুর রাজাকার। পরিবারটি সেই রাজাকারের খপ্পরে পড়ে। যুদ্ধে যাওয়া ছলিমের খোঁজে আসে মিলিটারি, না পেয়ে ধরে নিয়ে যায় কলিমকে। পরে কলিমকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র আর ছলিমের খোঁজে আবারও বাড়িতে হানা দেয়। দুটোর কিছুই না পেয়ে মেরে ফেলে কলিমকে।

আবার একপর্যায়ে, পাকবাহিনীর তাড়া খেয়ে বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আশ্রয় নেন। তাদের বের করে দিতে বললে, সেই মা তার প্রতিবন্ধী ছেলের হাতে রাইফেল দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন মিলিটারিদের রাইফেলের নলের সামনে। কিন্তু মিলিটারি আর তাদের সহযোগী রাজাকার দেখে না, নলের সামনের মানুষটি কে, কী তার পরিচয়। প্রতিবন্ধী ছেলের রক্তে বুক ভাসান মা, তবু মাথা নত করেন না।

এই চলচ্চিত্রে চাষী নতুন রূপে হাজির করেন বাউল-বৈষ্ণবদের। তারা যুদ্ধে অংশ নেন; দেশের অপমানের প্রতিবাদে প্রাণ দিতে হয় অখিল বাউলকে। সেই আক্ষেপ ঝরে পড়ে বৈষ্ণবীর কণ্ঠে ‘আমার আখড়া নেইরে সই, সব পুড়িয়ে ছারখার কইরে দিয়েছে। তবুও যদি ওই ভিনদেশি কুত্তাগুলি কইরতো তাও প্রাণে সইতো। কইরেছে সব আমাদের জাত ভাইয়েরা।’ আবার আখড়া থেকে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলা হয় এতে। সবমিলিয়ে হাঙ্গর নদী গ্রেনেড-এ চাষী অনেক বিষয়ে পরিমিতিবোধের পরিচয় দেন।

আরেক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, রাবেয়া খাতুনের কাহিনি অবলম্বনে চাষী নির্মাণ করেন মেঘের পরে মেঘ। সেখানে মুক্তিযুদ্ধোত্তর জন্ম নেওয়া একজনকে অবলম্বন করে এগোতে থাকে চলচ্চিত্রের কাহিনি। পিতৃপরিচয় সঙ্কটে ভোগা যুবক নিজের জন্মপরিচয় জানতে একসময় হন্যে হয়ে ওঠেন। বাবা হিসেবে নাম আসে রাজাকার মাজিদ মিয়া, পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সাদেক ও মুক্তিযোদ্ধা সেজান মাহমুদ-এর। কিন্তু ‘প্রকৃত’ বাবার পরিচয় জানতে মরিয়া যুবক মায়ের কাছে গেলে একটি ডায়েরির সন্ধান দেন তিনি। পিতৃপরিচয় জানতে যুবক শুরু করেন ডায়েরি পড়া। তখন ফ্ল্যাশব্যাকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করা হয়।

ফ্ল্যাশব্যাকে শুরু হওয়া মেঘের পরে মেঘ-এ একই চেহারার দুই যুবক মাজিদ ও সেজান একই সেক্টরে যুদ্ধ করতে গিয়ে কিছু সঙ্কটের সম্মুখীন হন। যে সঙ্কট উত্তরণে একে অন্যের পরিচয়ে একসময় হাজির হন পর্দায়। অন্যদিকে রাজাকার চুনি সেই সঙ্কটকে আরো উস্কে দিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। চাষীর এই চলচ্চিত্রেও রাজাকার আছে, তবে দাড়ি-টুপি নাই; আছে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণ; যুদ্ধ শেষে নারীদের ফিরে আসা, রাজাকারদের কাছে আবারও নারীর লাঞ্ছিত হওয়ার দৃশ্য। আরো আছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলার মাটিতে রাজাকার চুনিদের দৌরাত্ম্য এবং সেই রাজাকারের হাতে মুক্তিযোদ্ধা হত্যার মতো বিষয়ও।

উপরের তিনটি চলচ্চিত্রের কাহিনিতেই অনন্যতা আছে। তিনটি চলচ্চিত্রে চাষী তিন ধরনের বিষয় তুলে ধরেছেন। ওরা ১১ জন-এ যুদ্ধকালীন অবস্থা, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড-এ যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধকালীন চিত্র; আর মেঘের পরে মেঘ-এ যুদ্ধোত্তর সমাজে সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম্য। কাহিনির দিক দিয়ে চাষীর তিনটি চলচ্চিত্রই প্রশংসার দাবিদার। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র-নির্মাণে তিনি কাহিনির দিক থেকে অন্য যে কাউকে ছাড়িয়ে গেছেন তা বলতে দ্বিধা নেই। কিন্তু এর উপস্থাপন ঢঙে অনেকখানি চাপা পড়ার উপক্রম হয়েছে কাহিনির অনন্যতা। শুধু চাষী কেনো, বেশিরভাগ নির্মাতাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে কিছু বিষয়ের গতানুগতিক উপস্থাপন থেকে বেরোতে পারেন না। অবশ্য চাষী এই অবস্থা থেকে অনেকখানিই বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন, তবে পুরোপুরি পারেননি।

চাষীর প্রথম চলচ্চিত্র থেকে পরের গুলোতেও, এমনকি যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘মূলধারার’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তারা সবসময় কয়েকটি বিষয় চর্চা করে এসেছেন। এর মধ্যে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, রাস্তায় মিছিলে প্ল্যাকার্ডে লেখা কিছু অপরিবর্তনীয় বাণী, নারী ধর্ষণ, দাড়ি-টুপির রাজাকার অন্যতম। তবে সে ডিসকোর্স নির্মাণের দায় যে কেবল চাষীর, এমন নয়। তবে তিনি প্রথম হিসেবে নিঃসন্দেহে এর শুরু করেছেন। আর পরে তা চর্চা করেছেন অন্য নির্মাতারা।

কোনোভাবেই দায় এড়াতে

পারেন না চাষী

ডিসকোর্স একদিনে গড়ে ওঠে না। নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভাষার ব্যবহার ও চর্চার মাধ্যমে উৎপন্ন জ্ঞানের রিপ্রেজেন্টেশন থেকে হয় ডিসকোর্স। এটি গড়ে উঠতে যেমন বছরের পর বছর সময় নেয়, তেমনই ভাঙতেও প্রয়োজন হয় সময়ের। তাই হঠাৎ করে ডিসকোর্স ভাঙতে গেলে তা মেনে নেওয়া যায় না; প্রচলিত বিষয় ছেড়ে বের হয়ে নতুন কিছু গ্রহণ করতে গেলে আঘাত লাগে। যেমনটা আমরা পারি না মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটু অন্য ধরনের কোনো কিছু মেনে নিতে। চাষী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেই ডিসকোর্সের চর্চা শুরু করেছিলেন ওরা ১১ জন দিয়ে। সেই চর্চা থেকে পরবর্তী সময়ে দু-একজন ছাড়া কেউ বের হতে পারেননি!

নির্মাতারা ধরেই নেন, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হতে গেলে সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ, নারী ধর্ষণ ও দাড়ি-টুপি পরা রাজাকার থাকবে। সঙ্গে উঠে আসবে পাকসেনাদের বিকৃত মানসিকতা। আর এর বাইরে গেলেই সব শেষ। এই চিন্তার বাইরে গিয়ে কোনো নির্মাতা চলচ্চিত্র হয়তো নির্মাণ করতে পারবেন, কিন্তু মুক্তি দিতে পারবেন না, আর কোনোভাবে মুক্তি দিলেও তা প্রেক্ষাগৃহে চালাতে পারবেন না। ইতিহাস অন্তত তা-ই বলে। চাষীও তার সব চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের এ ডিসকোর্স ভাঙার কোনো ঝুঁকি নেননি। বরং ডিসকার্সিভ ফরমেশন প্রক্রিয়াকে নিয়মিত সহায়তা করেছেন ওরা ১১ জন, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড কিংবা মেঘের পরে মেঘ-এ।

চাষী নজরুলের শুরু করা সেই চর্চা থেকে বের হয়ে যখন তারেক মাসুদ মাটির ময়না (২০০২) কিংবা রুবাইয়াত হোসেন মেহেরজান (২০১১) নির্মাণ করেন, তখন কিন্তু সেটা তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। মাটির ময়না তো নিষিদ্ধই করা হয়। আর মেহেরজান ছয়টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলেও এক সপ্তাহের মধ্যে তা সরিয়ে নেওয়া হয়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশালের উত্থান, তার পরিণতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আলোচনায় এনে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন, ‘পূর্ব-পশ্চিম’’। যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দেওয়া থেকে শুরু করে স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত নানা চড়াই-উতরাই উল্লেখ করেছেন সুনীল। উপন্যাসে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি মানুষে মানুষে প্রেম-ভালোবাসাকে স্থান দিয়েছেন। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা বাবুলের বন্ধুর শ্যালিকা দিলারা ভালোবাসার টানে পশ্চিম পাকিস্তানি এক লেফটেন্যান্টকে বিয়ে করেন। তার মানে শিল্প-সাহিত্যের নানা মাধ্যমে এ ধরনের চর্চা অল্প হলেও আছে। এটাই মেহেরজান-এ রুবাইয়াত করেন, কিন্তু আমরা তা মেনে নিতে পারি না। মুক্তিযোদ্ধা চাষীর শুরু করা সেই চর্চা এতো শক্তিশালী হয় যে, চাষী নিজেও হয়তো সেটার বিপরীত কিছু করার, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখান না। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের প্রথম নির্মাতা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা-চাষীর কাছ থেকে এমন প্রত্যাশা কিন্তু খুব বেশি কিছু নয়। আগেই বলেছি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত মানবিক গল্পে চাষীর চলচ্চিত্রের অনন্যতা রয়েছে।

স্বাধীনতার চার দশক পরে এসে বিকল্পধারার নির্মাতারা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যখন মুক্তিযুদ্ধকে দেখার চেষ্টা করছেন বা করেছেন, তখন সেগুলো চাষীর পথে হাঁটা মূলধারার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এটাতো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে,

কোনো ধারার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রেই চূড়ান্তরূপে শৈল্পিক সমৃদ্ধি হয়তো অর্জন করতে পারেনি, তবু প্রচলিত ধারার চলচ্চিত্রের গতানুগতিক উদ্ভটত্বের চিহ্ন বিকল্পধারার চলচ্চিত্রে বিধৃত হয়নি। উপরন্তু, বহুধাবৈচিত্র্যপূর্ণ আঙ্গিকের আশ্রয়ে বিকল্পরীতির চলচ্চিত্রের বরং সমাজ, সংস্কৃতি বিশেষত যুদ্ধোত্তর আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র বিশ্বস্ততার সঙ্গে গৃহীত হয়েছে।

চাষী এ দায় এড়াতে পারেন না। কারণ চাষী নিজে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যে ডিসকোর্সের পার্ট হয়ে উঠেছেন, সেখানে তারেক কিংবা রুবাইয়াতদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকল্প ভাবনা ধোপে টেকেনি কখনো।

কেবল মুজিব-ই আছেন!

ভারতের জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বিশ্বে ‘মহাত্মা’ নামে পরিচিত। গান্ধীর এই মহাত্মা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ইতিহাসের কিছু ক্ষেত্রে গান্ধীর যে উপস্থাপন, সেখানে কেনো জানি তিনি কেবল একাই থাকেন; অন্যরা সবাই হারিয়ে যান! যেমন ভারতের স্বাধীনতা ও গান্ধীর জীবনী নিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত আলোচিত চলচ্চিত্র গান্ধীর কথাই ধরুন। এতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ইতিহাসে, মোটা দাগে বললে, গান্ধী ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না! গান্ধীর আলোয় অন্যরা ম্লান হন, নাকি ম্লান করে ফেলা হয় ঠিক জানি না! তবে এতে যেটা হয়, ইতিহাস অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ দেখুন, গান্ধীর এই মহাত্মা হয়ে ওঠার পিছনে কিন্তু দীর্ঘ ‘রহস্য’ আছে। যে ‘রহস্য’ কিছুটা হলেও তুলে ধরেছেন ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ লেখা মানুষগুলো। গান্ধীর মহাত্মা হয়ে ওঠার ‘রহস্য’ নিয়ে শাহিদ আমিন তার লেখা ‘গান্ধী যখন মহাত্মা’ প্রবন্ধের শুরু করেছেন এভাবে¾

১৯২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি গান্ধী পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলায় আসেন। এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়ে সেই রাত্রেই বারাণসীতে ফিরে যান। জনসমাবেশে এক থেকে আড়াই লাখ মতো মানুষ তাঁকে আবেগপূর্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিল। কিন্তু বিহারের চম্পারণে অথবা গুজরাটের খেড়ায় গান্ধীজী যেমন বেশকিছুকাল কাটিয়েছিলেন, গোরখপুরে তিনি তেমন কোনও সময় দেননি, ... এই অঞ্চলে সশরীরে গান্ধী ছিলেন একদিনেরও কম, কিন্তু মহাত্মার কল্পরূপ পরবর্তী মাসের পর মাস জনমনের চিন্তাভাবনা জুড়ে ছিল।

গান্ধীকে চলচ্চিত্রে এভাবে উপস্থাপনের দোষ হয়তো তার নিজের নয়। কিন্তু গান্ধী তার জীবদ্দশাতেও এই মহাত্মা নির্মাণ নিয়ে তেমন কিছু বলেননি। এবার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আসি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে ঘুরে-ফিরে কেবল আমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানই এসেছেন। ওরা ১১ জন-এ খসরুরা মিছিল করে, ‘তোমার নেতা, আমার নেতাশেখ মুজিব, শেখ মুজিব’। হাঙ্গর নদী গ্রেনেড-এও গ্রামের রাস্তায় একই স্লোগান দেয় জনতা¾‘তোমার নেতা, আমার নেতা¾শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’, ‘তোমার আমার ঠিকানা¾পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। আর মেঘের পরে মেঘ-এ এসব স্লোগান না থাকলেও পাকসেনাদের কথার মধ্য দিয়ে কেবল মুজিবই উঠে আসেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব এক অপরিহার্য নাম। কিন্তু তার মানে কী এই, সেখানে আর কেউ ছিলেন না! মুক্তিযুদ্ধে ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যুদ্ধের সময়টাতে তো শেখ মুজিব উপস্থিত থাকতে পারেননি। তখন এই যুদ্ধ চলেছে কাদের হাত ধরে, সেটা সঠিকভাবে জানা-বোঝা জরুরি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে সেসবের উপস্থাপন নেই বললেই চলে। চাষীও এই ধারার বাইরের কোনো নির্মাতা হয়ে উঠতে পারেননি। ওরা ১১ জন, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড-এ ওই ঘুরে-ফিরে কেবল ৭ মার্চ, মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক উপস্থিত; মুক্তিযুদ্ধকালীন নেতৃত্ব অনুপস্থিত।

এই প্রজন্মের সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি, কিন্তু ইতিহাস পড়ে ও দৃশ্যগত মাধ্যমে দেখেছে¾১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন; বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে লাখো মানুষের সে কী উচ্ছ্বাস! সেই মানুষের সামনের সারিতে ছিলেন ৭১-এর ১৭ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ অন্যরা। সেদিন মুজিবকে আলিঙ্গন করে তাজউদ্দীনের চুমু খাওয়ার সেই অভাবনীয় দৃশ্য কতোটা হৃদয়গ্রাহী, যারা দেখেছেন (সরাসরি বা ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে) কিছুটা হলেও সেই আবেগ অনুভব করতে পারবেন।

অন্যদিকে এটা হয়তো অনেকে জানেন কিংবা জানেন না, শেখ মুজিব গ্রেপ্তারের পর মুজিবনগর সরকার গঠনের আগে থেকেই দেশের যুদ্ধ পরিচালনার ভার নেন তাজউদ্দীন আহমেদ। আর ১৭ এপ্রিল সরকার গঠন হলে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করতে থাকেন তিনি। একদিকে সারাদেশ পাকিস্তানি হানাদার আক্রান্ত, অন্যদিকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থী; সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে বাংলার গণহত্যা সম্পর্কে বোঝানোর ভার পড়ে তাজউদ্দীনের ওপর। আর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে তো নিজ ও অন্য দলের ভিতর তাকে নিয়ে মতভেদ ছিলোই। শেষ পর্যন্ত সবই দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করেছেন তাজউদ্দীন। সর্বোপরি দেশ স্বাধীন হয়েছে তার নেতৃত্বে।

অথচ মুক্তিযোদ্ধা চাষীর কোনো চলচ্চিত্রেই এর ছিটেফোঁটা থাকে না। তাজউদ্দীনকে নিয়ে নির্মিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে জোহরা তাজউদ্দীনের বরাত দিয়ে বলা হয়-তাজউদ্দীনের একটা দুঃখ ছিলো, বঙ্গবন্ধু কখনোই নিভৃতে তাকে জিজ্ঞেস করেননি; তাজউদ্দীন, এই নয় মাস কীভাবে দেশ চালিয়েছো? শুধু শেখ মুজিব নন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রনির্মাতাদের অধিকাংশই এ বিষয়টি জানতে চাননি, চাষী তো ননই!

নতুন ইতিহাস রচনা হোক

সময় এসেছে ইতিহাসকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার। যে দেখা শুরু করেছেন রণজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আদিকল্পও ভাঙতে হবে। যেভাবেই হোক চাষী সেই ইতিহাসের কাছে গেছেন তার হাঙ্গর নদী গ্রেনেড নিয়ে। আর যাই হোক নারী সেখানে হাজির থেকেছে একেবারে ভিন্নরূপ নিয়ে। হাঙ্গর নদী গ্রেনেড-এর ওই নারী-মা কেবল ‘তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো’ ডিসকোর্সের অংশ নন। তিনি একজন মা, একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাও। যিনি মা হিসেবে সন্তানদের দেশের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন, আবার প্রয়োজনে মায়ের অবস্থান থেকে বেরিয়ে কৌশলে নিজের সন্তানের জীবনের বিনিময়ে বাঁচিয়েছেন আশ্রিত মুক্তিযোদ্ধাদের! চাষীর এই মা অন্তত মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত গতানুগতিক নারী নন। চলতি ইতিহাস কোন কাতারে ফেলবে এই নারীকে? তার মানে চাষীর এই সক্ষমতা ছিলো। কিন্তু ...

লেখক : ইমরান হোসেন মিলন, টেকনোলজি ও টেলিকম বিষয়ক অনলাইন সংবাদমাধ্যম টেকশহর ডটকম-এ স্টাফ কনটেন্ট কাউন্সিলর পদে কর্মরত।

milonmcru@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. ম্যাজিক লণ্ঠন, জুলাই, ২০১২ সংখ্যায় চাষী নজরুল ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। ‘আমি সিনেমা বানাতে জানি, আমি সিনেমাই খাই, ঘুমাই, স্বপ্ন দেখি-আর কিছু জানি না’ শিরোনামের সেই সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া।

২. চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (২০০৪ : ৫); ‘ভূমিকা :‘নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস’; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা : গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

৩. ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ২৪১-২৪২); বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ; ভাষাচিত্র, ঢাকা।

৪. গ্রাগুক্ত; ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ২৪২)।

৫. গ্রাগুক্ত; আলমগীর কবির, উদ্ধৃত; ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ২৪২)।

৬. গ্রাগুক্ত; ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ২৪২)।

৭. গ্রাগুক্ত; ইসলাম, আহমেদ আমিনুল (২০১৪ : ২৪৫)।

৮. আমিন, শাহিদ (২০০৪ : ৪৭); ‘গান্ধী যখন মহাত্মা’; নিম্নবর্গের ইতিহাস; সম্পাদনা : গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

৯. তাজউদ্দীন আহমদ : নিঃসঙ্গ সারথি, তাজউদ্দীন আহমেদকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র। যেখানে তাজউদ্দীন সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানিয়েছেন তার সহধর্মিনী জহুরা তাজউদ্দীনসহ অন্যান্যরা। https:/ww/w.youtube.com/watch?v=FvHNPwshgA4 এই লিঙ্কে তিন খণ্ডে সেটি পাওয়া যাবে।


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন