Magic Lanthon

               

নাজমুল রানা

প্রকাশিত ১০ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণে চাষী

ফর্মুলার তোড়ে ভেসে যাওয়া রাবীন্দ্রিক উপাখ্যান

নাজমুল রানা


চিত্রকল্পের সঙ্গে বসবাস

গভীর চাঁদনী রাত, চারিদিকে ঠিকরে পড়ছে জোছনা; বাতাসের হিল্লোলে বার বার কেঁপে উঠছে গাছের পাতা। বটগাছের নীচে পড়ে আছে একটি মৃত শালিক, চারপাশে কেউ নেই; মায়াবী অথচ গুমোট পরিবেশ। দেখে কবি হয়তো লিখলেন দু-চার লাইন, সাহিত্যিক নানা উপমায় তুলে ধরলেন গল্প কিংবা উপন্যাসে। পাঠক সে সাহিত্য বা কবিতা পড়ে চলে যান জোছনা ঝরা রাতের সেই বটতলায়; মরা শালিকের হৃদয়ের বেদনাটুকু অনুধাবন করেন নিজের হৃদয় দিয়ে।

কবি-সাহিত্যিকের কালো অক্ষরের সেই উপমা, কাহিনিকে কেউ আবার তুলে আনেন ক্যামেরায়। তার হাতে আছে আরো একটু বেশি শক্তিশালী মাধ্যম, আছে কলমের কালিকে পর্দায় সশব্দে তুলে ধরার হাতিয়ার। পাঠক সাহিত্য পড়ে যে ইমেজ নিজের কল্পনায় নির্মাণ করেন, তিনি তাকে সে ইমেজ দেখান জীবন্ত করে। সাহিত্যে বর্ণিত বাস্তবতাকে পর্দার বাস্তবে তুলে আনতে পারেন। তিনি বাতাসে নড়া বটপাতার শব্দ যেমন দর্শককে শোনাতে পারেন, তেমনই দেখাতে পারেন মৃত শালিকের ধূসর চোখ; যা আরো অর্থবহ দ্যোতনা তৈরি করে। এতক্ষণ বলছিলাম চলচ্চিত্রনির্মাতার কথা। তবে নির্মাতার উপস্থাপন যে সাহিত্যকে ছাড়িয়ে যাবে¾এটা বলা মুশকিল। কারণ, নির্মাতার আছে নানা সীমাবদ্ধতা! তিনিও তার কল্পনার ইমেজকেই পর্দায় রূপ দেন।

আগেই বলেছি নির্মাতা সব ঘটনা দেখেন ক্যামেরার চোখ দিয়ে। সাহিত্যিক যে কাজ লেখার মাধ্যমে করেন, নির্মাতাকে সে কাজ করতে হয় ক্যামেরার মাধ্যমে; মানে সাহিত্যিকের কলম আর চলচ্চিত্রনির্মাতার ক্যামেরা। সাহিত্যিক যেমন পাঠকের সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি করেন ভাষিক বর্ণনায়, নির্মাতা সে কাজটিই করেন ক্যামেরার ভাষায়, নানা ডিটেইলের মধ্য দিয়ে।

উপমহাদেশে যে ক’জন সাহিত্যাশ্রয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তাদের মধ্যে সবার আগে আসে সত্যজিৎ রায়ের নাম। তিনি বিখ্যাত সব সাহিত্যকে চলচ্চিত্রে রূপান্তর করেছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরের সাহসও তিনি দেখিয়েছিলেন। তারপর ঋতুপর্ণ ঘোষ, যিনি রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে রেখেছেন স্বীয় মননশীলতার স্বাক্ষর। বাংলাদেশে যারা সাহিত্যাশ্রয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, চাষী নজরুল ইসলাম তাদের মধ্যে অন্যতম; যিনি শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মতো সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম থেকে নির্মাণ করেছেন চলচ্চিত্র। আজকের আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে চাষী নজরুলের নির্মিত চলচ্চিত্র। আলোচনা এগিয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ ও ‘শাস্তি’ থেকে চাষীর সুভাশাস্তিতে।

একই কর্মের ভিন্ন প্রকাশ

‘একজন পরিচালক বার বারই তাঁর ছবির বিষয় হিসেবে ফিরে যান সাহিত্যের কাছে।’ প্রামাণ্য ঢঙ থেকে বেরিয়ে চলচ্চিত্র যেদিন কাহিনির দিকে পা বাড়ালো, সেদিন থেকেই রচিত হলো সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের এই সেতুবন্ধন। চলচ্চিত্রের শুরুর দিকে যা ঘটেছে হুবহু সেটাই তুলে আনা হতো ক্যামেরায়, তাই কাহিনির দরকার পড়েনি। ধীরে ধীরে চলচ্চিত্র উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে থাকলো, যা ঘটেছে তা-ই হুবহু তুলে আনার গণ্ডিতে সন্তুষ্ট থাকতে পারলেন না নির্মাতারা। তারা পর্দায় নিজেদের গল্প বলতে চাইলেন, আর গল্প বলার প্রয়োজনই তাদের টেনে নিয়ে গেলো কাহিনির কাছে। সাহিত্য যেহেতু গল্প বা কাহিনির বিস্তৃত আধার, তাই নির্মাতারা নিজের গল্পের পাশাপাশি সাহিত্য থেকেও কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে থাকলেন। এভাবে একটু একটু করে মজবুত হতে লাগলো সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের সম্পর্ক।

তবে সব ভালো সাহিত্যকর্মই যে ভালো চলচ্চিত্র হতে পেরেছে এমনটি নয়। অনেক দুর্বল সাহিত্যকর্ম যেমন নির্মাতার সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় অমরত্ব লাভ করেছে, তেমন অনেক মহৎ সাহিত্যকর্মও নির্মাতার অদক্ষতা ও মননশীলতার অভাবে হারিয়ে গেছে কালের অতল গহ্বরে। কারণ পরস্পর সংযুক্ত হলেও সাহিত্য ও চলচ্চিত্র দুটি ভিন্ন মাধ্যম। মা ইলিশ ডিম ফোটানোর প্রয়োজনে নদীতে আসলেও ইলিশ যেমন নদীর মাছ নয়, ঠিক তেমনই সাহিত্যের কাছ থেকে কাহিনি নিলেও চলচ্চিত্র আর সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে ভিন্ন।

তাই সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে নির্মাতাকে তার নিজস্ব সৃজনশীলতার আশ্রয় নিতে হয়; ঠিক করতে হয় তিনি কীভাবে কাহিনিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিবেন। গল্প বলার ঢঙের ওপরই চলচ্চিত্রের সফলতা অনেকখানি নির্ভর করে। অনেক সময় দেখা যায় বক্তার বক্তব্য শুনে দর্শক মুগ্ধ হয়ে নিবিড় দৃষ্টিতে বক্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, আবার কখনো মনোযোগ হারিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে অথবা উঠে চলে যায়। এখানে যে বিষয়টি কাজ করে তা হলো, বক্তার উপস্থাপনার ধরন। ভালো উপস্থাপনা যেমন শ্রোতাকে আটকে রাখে; তেমনই খারাপ উপস্থাপনা ঘুমাতে কিংবা উঠে যেতে বাধ্য করে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও একই কাজ হয়ে থাকে।

তবে সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ তখন আরো কঠিন হয়ে পড়ে, যখন সে সাহিত্য হয় বহুল পঠিত। কারণ¾

সেসব লেখা বিভিন্ন সময়ে বার বার পড়তে পাঠক তার ভালো লাগার ছবিগুলি এঁকে রাখেন মনের মধ্যে। সাহিত্যের চরিত্রগুলিকে পাঠক দেখতে পান, তাঁর নিজের দেওয়া সেসব অবয়ব গেঁথে যায় তার হৃদয়ে। ... এ সবই চলতে থাকে অনেক সময় ধরে একাধিক পাঠের মধ্যে দিয়ে। সেসব সাহিত্য সিনেমায় রূপান্তরিত হয়। সেই সিনেমা দেখতে গিয়ে অনেক সময়ই পাঠক চায় তার মনের ভেতরে ডুব দিয়ে থাকা সেই ছবিগুলির সঙ্গে পর্দার ছবিগুলিকে মিলিয়ে নিতে। মেলে না কখনো।

তখনই বাধে বিপত্তি। যে বিষয়ের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন, নির্মাণের আগে তার একটা দৃশ্যকল্প মাথায় এঁকে নেন নির্মাতা। তারপর তার কল্পনার ইমেজকে তিনি চলচ্চিত্রে রূপদানের লক্ষ্যে রচনা করেন চিত্রনাট্য। সাহিত্য যে ইমেজকে লেখক-পাঠকের সামনে উপস্থাপন করে তার বাক্য বিন্যাসের বর্ণনা দিয়ে, চলচ্চিত্রে নির্মাতা সে কাজটি করে থাকেন ক্যামেরায় ধরা ইমেজ সাজিয়ে। তাই ক্যামেরার চোখই নির্মাতার চোখ হয়ে ওঠে। অনেক সময় একটা বিষয়কে খালি চোখে যেভাবে দেখায়, ক্যামেরার চোখে সেটা সম্পূর্ণ অন্যরকমও মনে হতে পারে। তাই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে নির্মাতাকে জানতে হয় চলচ্চিত্রের ভাষা, মানে ক্যামেরার ভাষা।

সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রে ইমেজ কীভাবে কাজ করে, এবার যাবো সে প্রসঙ্গে। আমরা যা কিছু ভাবি তার একটা ইমেজ বা চিত্রকল্প আমাদের মস্তিষ্ক তৈরি করে নেয়। পূর্বে কখনো দেখিনি এমন কারো নাম শোনার পরও আমাদের মস্তিষ্কে তার একটা চিত্র ভেসে ওঠে, আমরা তাকে দেখতে পাই; হতে পারে বাস্তবের সেই ব্যক্তি আর আমাদের কল্পিত চিত্রকল্পের সেই ব্যক্তি দেখতে এক নয়। মানে আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের ভাবনার আকাশে জড়ো হওয়া সবকিছুরই একটা চিত্রকল্প দাঁড় করায়। যে জীবনে সমুদ্র দেখেনি তার সামনে সমুদ্র শব্দটা বললে সেও তার মতো করে সমুদ্র দেখতে পায় বা সমুদ্রের চিত্র মাথায় এঁকে নেয়।

সাহিত্য অর্থাৎ গল্প, কবিতা, উপন্যাস পাঠকালেও এর ব্যতিক্রম হয় না। আমরা যা পাঠ করি সেটা আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই; তবে নিজের মতো করে। ব্যক্তি ভেদে স্বাভাবিক নিয়মেই এ দেখার ধরন পাল্টায়। ‘হৈমন্তী’ পাঠের সময় যে হৈমন্তী চোখের সামনে হেঁটে বেড়াবে, সেই হৈমন্তী আর অন্য একজন পাঠকের কল্পনার হৈমন্তী এক নয়। সাহিত্যের এ ইমেজ সাহিত্যিক তৈরি করেন ভাষিক বর্ণনায়। আর চলচ্চিত্রের প্রাণই হলো ইমেজ। ‘কেননা সিনেমা মূলত ইমেজ দিয়েই তৈরি হয়। শব্দকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়েও নৈশব্দের সিনেমার কথা ভাবা যায়। কিন্তু ‘ইমেজ’কে বাদ দিয়ে সিনেমার কথা কখনোই ভাবা যায় না।’ এ ইমেজের একটা আলাদা ভাষা আছে, এখানে ইমেজই কথা বলে। যখন পর্দায় কোনো সিঁদুর ও শাঁখা পরিহিত নারী-চরিত্র ভেসে ওঠে, তখন দর্শকদের বুঝে নিতে কষ্ট হয় না ইনি বিবাহিত; আর এটাই ইমেজের শক্তি।

সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে পারে বিভিন্নভাবে। নির্মাতা যেমন মূল কাহিনিতে বর্ণিত সময়কে ধরে চলচ্চিত্র বানাতে পারেন, প্রয়োজনে কাহিনির আংশিক নিতে পারেন, আবার বিনির্মাণও করতে পারেন। বিনির্মাণটা অনেকটা এ রকম যে, কাহিনির ভাব পুরোপুরি নেওয়ার পাশাপাশি কাহিনির বক্তব্যকে ছাড়িয়ে যাওয়া। যেমনটি ঋতুপর্ণ ঘোষ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ থেকে। ঋতু মূল থিমকে রেখে যে চিত্রাঙ্গদা নির্মাণ করেন তা ‘চিত্রাঙ্গদা’কে ছাড়িয়ে গেছে। ঠাকুরের চিত্রাঙ্গদা হলো নারী, তাকে বড়ো করা হয়েছিলো পুরুষের মতো করে। আদতে সে দেহ ও মন¾দুটোতেই নারী। আর ঋতুপর্ণের রুদ্রের দৈহিক গঠন পুরুষের মতো হলেও মনটা নারীর।

কাদা থেকে মূর্তি : মৃৎশিল্পী চাষী      

রবীন্দ্রনাথ খানিকটা আক্ষেপের সুরেই বলেছিলেন, ছায়াচিত্র এখনো পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুবৃত্তি করে চলেছে¾তার কারণ কোনো রূপকার আপন প্রতিভার বলে তাকে এই দাসত্ব থেকে উদ্ধার করতে পারেনি।  তিনি এখানে চলচ্চিত্র কী কারণে সাহিত্যের চাটুবৃত্তি থেকে বের হতে পারছে না সেটাও বলে দিয়েছেন, অভিযোগের তির ছুড়েছেন নির্মাতার দিকে। তার এ অভিযোগ অমূলক নয়। কারণ চলচ্চিত্রকে বলা হয় ডিরেক্টরস্ মিডিয়াম, এখানে নির্মাতার কথাই সর্বশেষ ও একমাত্র; তিনি যা বলবেন তা-ই হবে। অনেকে এর গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলে থাকেন, চলচ্চিত্রে নির্মাতার কথা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না।

তাই সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে নির্মাতাকে নিজস্ব সৃজনশীলতা ও মননশীলতার আশ্রয় নিতে হয়। ‘সাহিত্য বড়োজোর ছবিটির গল্পের কাঠামো দাঁড় করাতে পারে, কিন্তু তাতে প্রাণসঞ্চার, ভাষাদান পরিচালকের মস্তিষ্কপ্রসূত সৃষ্টিই হতে হয়।’ আর এজন্য কল্পনার ইমেজকে চিত্রায়ণে নির্মাতাকে লিখতে হয় চিত্রনাট্য। একটি ভালো চিত্রনাট্যই একটি চলচ্চিত্রকে অনেকখানি উৎকৃষ্টতার দিকে নিয়ে যায়। এজন্য নির্মাতাকে জানতে হয় ‘সিনেমার ভাষা, সাহিত্যের ভাষা থেকে যা বহু যোজন দূরে। চিত্রনাট্যকারকে তার হাতের আঙুলের মতো ঘনিষ্ঠভাবে চিনতে হয় মুভি ক্যামেরার সর্বাসর্ব, বুঝতে হয় ফিল্ম এডিটিং-এর মর্মার্থ, ছুঁতে জানতে হয় শব্দ ও নৈশব্দের স্বরকে।’

সাহিত্যে যে কথাগুলো লেখক পাঁচ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন, চলচ্চিত্রে অনেক সময় নির্মাতাকে সে কথাগুলো বলতে হয় মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। চলচ্চিত্রে নির্মাতা নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেন, তিনি লেখকের মতো মর্জি মাফিক পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারেন না। তাই তাকে অনেক সংলাপের কাজ নৈশব্দ দিয়ে বোঝাতে হয়। সাহিত্যকর্মের ভাষা ও চলচ্চিত্রের ভাষা এক না হওয়ায় অনেক সময় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে অস্পষ্টতা তৈরি হয়। নির্মাতাকে নিজ দক্ষতায় সেই অস্পষ্টতাকে পর্দায় স্পষ্ট করে তুলতে হয়। সেজন্য

একজন সাহিত্যিক উপন্যাসের গতি নিয়ে যতটা সিরিয়াস, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে তার চেয়ে দ্বিগুণ সিরিয়াস থাকতে হয়। গল্পের গতি নিয়ে চলচ্চিত্রের প্রধান বাহনই হচ্ছে গতি, প্রতিনিয়ত যা পরিবর্তিত হচ্ছে নানা দৃশ্যের মধ্য দিয়ে, গতিই এগিয়ে নিয়ে যায় চলচ্চিত্রের কাহিনীকে। অন্যদিকে একজন ঔপন্যাসিক সংলাপ রচনায়, চরিত্র নির্মাণে ব্যয় করতে পারেন পাতার পর পাতা। তার বর্ণনা হতে পারে হাজার লাইনের, কিন্তু চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে সেটা একেবারেই অসম্ভব।

আবার ভালো চিত্রনাট্য হলেই যে ভালো চলচ্চিত্র হবে¾সেটা বলারও জো নেই। তাই কোন গল্পের কোন চরিত্রের অভিনয় কোন সুরে বাঁধতে হবে¾সে বোধ নির্মাতার থাকা চাই। নির্মাতা যদি চরিত্রানুযায়ী অভিনেতা নির্বাচন এবং তাদের কাছ থেকে অভিনয় আদায় করে নিতে না পারেন, তবে অনেক ভালো চিত্রনাট্য লেখা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রটি সাফল্যের মুখ নাও দেখতে পারে; অথবা শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর হয়ে যেতে পারে। বাঁদর হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই উপরের সবগুলো কাজ করতে হয়েছে চাষী নজরুল ইসলামকে। এখন দেখার বিষয় সেই কাজগুলো তিনি কীভাবে করলেন।

গল্প ‘শাস্তির’ ভাগ্যেও শাস্তি!

চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মাধ্যম হচ্ছে ছোটগল্প। ছোটগল্পই একমাত্র একজন পাঠক বা দর্শককে এক বসায় গল্পটি শেষ করতে বাধ্য করতে পারে।  এভাবেই বলেছিলেন বিখ্যাত নির্মাতা আলফ্রেড হিচ্কক। হিচ্কক হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন, ‘ভালো’ ছোটোগল্প যেমন পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে, ‘ভালো’ চলচ্চিত্রও সে কাজটি করতে পারে। তবে সব ছোটোগল্প পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। আবার পাঠককে ধরে না রাখতে পারলেই যে সে ছোটোগল্প ব্যর্থ¾এমনটা বলারও উপায় নেই। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ধ্রুপদী শিল্প আছে, যা কখনোই জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে সাহিত্যে বা চলচ্চিত্রে যেহেতু পাঠক বা দর্শক একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই একে ছোটো করে দেখারও উপায় নেই। এজন্য নির্মাতাকে ছোটোগল্প বা সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে নিজস্ব সৃজনশীলতা ও মেধা কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু সংযোজন-বিয়োজন করতে হয়। গল্পে বর্ণিত নানা অস্পষ্ট বিষয়কে দর্শকের সামনে বিভিন্ন দৃশ্য ও ডিটেইল ব্যবহার করে স্পষ্ট করে তুলতে হয়; তবে তা করতে হয় মূল কাহিনির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই।

চাষী নজরুল শাস্তি নির্মাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প ‘শাস্তি’ থেকে। তাই সদর্পে চলচ্চিত্রের শুরুতেই বলে দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রথম অনুপম চলচ্চিত্রায়ন’। রবীন্দ্রসাহিত্যের এই চলচ্চিত্রায়ণ যে ‘অনুপম’, সেটা তিনি চলচ্চিত্র শুরুর আগেই দর্শকের কাছে একটু নিজের ঢোল পিটিয়ে বলে নিলেন। এখন দেখা যাক, পেটাতে পেটাতে শেষ পর্যন্ত চাষী এই ঢোল ফাটিয়ে ফেলেন কি না? কারণ, চলচ্চিত্র দেখার আগেই যে সিদ্ধান্ত তিনি দর্শককে দিলেন, দর্শক যদি দেখার পর তা মেনে না নেয়, তাহলে কিন্তু তারা এসে রাগে-ক্ষোভে পিটিয়ে ঢোল ফাটিয়ে ফেলবে! সেই ঝুঁকি নিয়েই চলুন দেখি চাষীর ‘অনুপম’ চলচ্চিত্রের অনুপমতা।

ক. ফর্মুলার ফেরে রবীন্দ্রনাথ

চাষীর শাস্তি শুরু হলো ছিদাম ও চন্দরার ‘ন্যাকামিপূর্ণ’ প্রেম দিয়ে, সঙ্গে সেই ‘ন্যাকা ন্যাকা’ প্রেমের সংলাপ। ‘ন্যাকা’ বললাম এজন্য, সেই গতানুগতিক প্রেম; মানে নায়ক লেগে আছে নায়িকার পিছে, নায়িকা কিছুতেই পাত্তা দিচ্ছে না। মাঝখানে ভিলেন রূপে আবির্ভূত হলেন নায়িকার বাবা। নায়ককে প্রহার করলেন, দেখে নায়িকার দিলদরিয়া দরদে উতলে উঠলো; নায়িকা এবার নায়কের প্রতি দেওয়ানা। শুরু হয়ে গেলো প্রেম, নিয়ম মাফিক তার পরিণাম মিলন, মানে বিয়েতে গড়ালো। নিয়ম-মাফিক বলার পিছনে কারণ হলো, মিলন বা বিয়েতে গড়ায়নি এমন প্রেমের সংখ্যা ফর্মুলা চলচ্চিত্রে খুবই কম। আর এর মধ্যে মধ্যে তো রোমান্স জাগানিয়া গান থাকছেই।

ছিদাম-চন্দরার এই উপস্থাপন বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের একেবারেই প্রচলিত কাঠামো, যাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফর্মুলা বলা হয়। যেখানে গল্প বলার ধরন আটকে যায় প্রচলিত ন্যারেটিভের আদি-মধ্য-অন্ত পরম্পরার গণ্ডিতে। দর্শক যার শুরুটা দেখলে বলে দিতে পারে এর শেষে কী ঘটবে। মাঝে মাঝে গল্প বলার ধরনে কিছু পার্থক্য দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা একই বৃত্তে ঘুরপাক খায়। ফলে কাহিনিতে প্রেম, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, বিচ্ছেদ ও মিলন রুটিন উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। আর উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে যেহেতু গান অন্যতম আনুষঙ্গিক বিষয়, তাই ফর্মুলাকে পাকাপোক্ত করে গান। ডাচ গবেষক লোটে হুক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ থেকে ফর্মুলা চলচ্চিত্রের উপাদান সম্পর্কে বলেন, ‘ছয়টা গান + দশটা মারপিট + একটা প্রেম = বাংলা ছবি?’

মূল গল্পে যেখানে ছিদাম-চন্দরার প্রেমের উল্লেখই নেই, সেখানে শাস্তির একটা বড়ো অংশ জুড়ে থাকলো ‘প্রেমলীলা’। চাষী হয়তো সচেতনভাবেই এই ‘বিশুদ্ধ বাণিজ্যিক’ ফর্মুলার নিয়ম রক্ষা করতেই শাস্তিতে এ প্রেম উপস্থাপন করেছেন। অবশ্য এটাকে নির্মাতা হিসেবে চাষীর স্বাধীনতা বলা যেতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা মানে তো স্বেচ্ছাচারিতা নয়। তাই চাইলেই তিনি রাবীন্দ্রিক প্রেমকে টেনে কখনো ধুলোয় আবার কখনো আসমানে তুলতে পারেন না।

খ. সুড়সুড়ির দোষে ‘দুষ্ট’ চাষীও

মূল গল্পে ‘চন্দরা দেখিয়াছিলো, তাহার স্বামী কাজের ওজর করিয়া মাঝে মাঝে দূরে চলিয়া যায়, এমন-কি দুই-একদিন অতীত করিয়া আসে, অথচ কিছু উপার্জন করিয়া আনে না।’ রবীন্দ্রনাথের এ ইঙ্গিতকে চাষী শাস্তিতে তার মতো করে স্পষ্ট করে তুললেন। মানে মূল গল্পের অস্পষ্টতা নির্মাতাকে নিজের মতো করে নির্মাণের যে সুযোগটুকু দেয়, চাষী সেটুকু নিলেন। আর ‘মাঝে মাঝে দূরে চলিয়া’ যাওয়ার সুযোগে তিনি দেখালেন অন্য গ্রামে ছিদামের নেশা করতে যাওয়াকে। নির্মাতা অবশ্য সেটা দেখাতেই পারেন। তবে সেখানেও সেই পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটান চাষী। ফর্মুলায় ফেলে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তিনি যেমন প্রেম টেনে আনেন, ফর্মুলা মেনে গান দেখান; তাহলে আর হালের আইটেম সঙ বাকি থাকবে কেনো?

এবার সে সুযোগ হাতছাড়া করেন না তিনি। ছিদামের নেশার তালে চলে ‘আইটেম গার্লের’ নাচ আর তার ঠোঁটে (লিপসিঙ) থাকে ‘সিঙ কেটে ঢুইকেছে চোর/ খুলতে চায় খিরকি দ্বোর/ খিল দরজা পিছল বড়ো আঁছাড় খাইয়ে পইড়েছে/ মইরেছেরে মইরেছে/ মইরেছে চোর মইরেছে’। বলিউডি আইটেম সঙ যেমন কাহিনির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই চলচ্চিত্রে হাজির হয়, এখানেও তাই হলো। আর হবেই না-বা কেনো? রবীন্দ্রনাথের ‘অনুপম’ চলচ্চিত্র-নির্মাণের তাগিদ (!) বলে কথা। অনুপম প্রকল্পে যেখানে টাইটেল কার্ড দেখানোর সময় থেকে ‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে’ গান দিয়ে রাবীন্দ্রিক ঘোর লাগানোর চেষ্টা থাকে, সেখানে ৪৭ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে ‘সিঙ কেটে চোর ঢুকে, খিরকি দুয়ার খুলতে চায়’! কাহিনির সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্কহীন এই কথা ও নাচ দিয়ে চাষী ঠিক কীসের ইঙ্গিত করেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না। চাষী হয়তো টেলিভিশনে শেভিং ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, যেখানে ক্রিম পুরুষের জন্য হলেও ‘আবেদনময়ী’ নারীর খোলা বুক-পিঠের দরকার পড়ে!

এছাড়া চাষীর এই উদ্দেশ্য আরো স্পষ্ট হয়, শাস্তির ৫৬ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে রামলোচনের লুকিয়ে পুকুরে চন্দরার গোসল দেখার দৃশ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। যখন রামলোচন কামুক দৃষ্টিতে চন্দরার জলে ভেজা শরীর দেখতে দেখতে বলে, ‘এ কি! ছুড়িকে যতই দেখছি, ততই আমার মনের মধ্যে কচকচ কচকচ করতিছে। হি হি হি। দেখলেই মন ভইরে যায়, বিনোদিনী।’ এখানেও সেই একই অভিযোগ, কাহিনির প্রয়োজনে আদৌ এই দৃশ্যের কী দরকার ছিলো? হয়তো রবীন্দ্রনাথের ‘অনুপম’ চলচ্চিত্র নির্মাণে ‘স্নিগ্ধ’ নারীর ভেজা শরীরও দরকার পড়ে!

গ. শিব গড়তে বাঁদর

রবীন্দ্রনাথ আপাত খারাপ কিংবা ভালো যে চরিত্রই তার সাহিত্যে সৃষ্টি করুন না কেনো, সেই বাস্তবতায় তার মধ্যে পরিমিতি, দৃঢ়তা ও পরিপাট্য বোধ থাকে; ‘শাস্তি’র ছিদামও তার ব্যতিক্রম নয়। ‘শাস্তি’তে রবীন্দ্রনাথ ছিদামকে উপস্থাপন করেছেন পরিমিত, দৃঢ় ও পরিপাট্যবোধ সম্পন্ন রূপে। কিন্তু চাষীর শাস্তির ছিদাম কেনো জানি হয়ে গেলো ন্যাকামিতে ভরপুর এক এলোমেলো ও অগোছালো মানুষ। পুরো চলচ্চিত্রে যার ন্যাকামি ও বিচলতা ব্যতীত আর কিছুই চোখে পড়ে না। চন্দরার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মূল গল্পের ‘দৃঢ়, চঞ্চল ও কৌতূহলী’ চন্দরাও শাস্তিতে এসে ‘ন্যাকা ও বোকা’র আবরণে আবৃত হয়ে ছেলেমিপনায় পূর্ণ হয়ে গেলেন।

আবার দুখিরামের বেলায় চাষী হাঁটলেন একেবারে উল্টো পথে! রবীন্দ্রনাথের ‘সবল অচল নিরুপায়’ দুখিরামকে চাষী সচল করে তুললেন; বানিয়ে ফেললেন ‘দৃঢ়তার’ প্রতীক। মূল গল্পের ‘সমস্ত কাজেই ছিদামের উপর দুখিরামের একমাত্র নির্ভর’-এ কথা শাস্তিতে এসে পাল্টে গেলো! ছিদাম হয়ে পড়লেন দুখিরামের ওপর নির্ভরশীল। ঠিক ফর্মুলা চলচ্চিত্রে যেমনটি প্রায়ই ঘটে। মানে বড়ো ভাই ছোটোকে শাসন করছে, আবার আদর দিয়ে মাথায় তুলছে কিংবা বিপদে-আপদে বুক চিতিয়ে দিচ্ছে; মাঝে মধ্যে জীবন পর্যন্ত অকাতরে দিয়ে দিচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এখানেও চাষী শেষরক্ষা করতে পারেননি, হঠাৎ করেই চলচ্চিত্রের শেষের দিকে দুখিরামকে নিয়ে গেছেন মূল গল্পের জায়গায়, তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন সেই ‘অচলতা’! অনেকটা আগুন থেকে তুলে আবার আগুনে নিক্ষেপ করার মতো আর কি।

এ তো গেলো মূল গল্পে উল্লেখ আছে এমন চরিত্রের কথা। এবার আসি চাষী সংযোজিত চরিত্রের কাছে। আগেই বলেছিলাম, সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে নির্মাতা কাহিনির প্রয়োজনে সংযোজন-বিয়োজন করতে পারেন, সে অধিকার নির্মাতার আছে। চাষী হয়তো সেই অধিকারটুকুই কাজে লাগিয়ে সংযোজন করেছেন ‘ভুলভাল’ ইংরেজি আওড়ানো এক পণ্ডিতকে। যে শেখায়, ম্যান ইজ মর্টাল মানে ‘মারো, ধরো, কাটো’! রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে ‘অনুপম’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে চাষী ঠিক কেনো এ ধরনের এক ‘হাস্যকর’ চরিত্র সংযোজন করলেন, বোঝা দায়! হালকা চটুল এই চরিত্র তো শেষ পর্যন্ত ‘অনুপম’ চলচ্চিত্রনির্মাতা চাষীকেই হালকা-চটুল করে তোলে!

ঘ. গণেশ উল্টে গেলো!

মূল গল্পের দুই জা’র মধ্যকার দা-কুমড়া সম্পর্ক শাস্তিতে এসে ‘মধুর’ সম্পর্কে রূপ নেয়। চন্দরাকে রাধা ছোটো বোনের মতো ভাবে, চন্দরা তাকে দেখে দিদির মতোই। যা অনেকটা প্রচলিত ফর্মুলা চলচ্চিত্রের দেবরের বউয়ের প্রতি বড়ো ভাবীর ‘উপচে’ পড়া স্নেহ ও ভালোবাসার মতো। সেটাও হয়তো নির্মাতার স্বাধীনতা! তবে বিপত্তি বাধে তখনই, যখন গল্পকে ট্র্যাজেডির দিকে টেনে আনার জন্য চাষী আবার মূল গল্পের দা-কুমড়া সম্পর্কের কাছে ফিরে যান।

আবার ছিদাম-চন্দরার সংশয়ের সম্পর্ককে ‘সুদৃঢ়’ সম্পর্ক বানানোর চেষ্টা করতে গিয়েও খেই হারিয়ে ফেলেন চাষী। সেখানেও তিনি শেষমেষ মূল গল্পের আশ্রয়ই নেন! কিন্তু কেনো? যখন চাষী দেখেছেন নিজের আঁকা ছকে নিজে ‘বন্দি’ হয়ে যাচ্ছেন, তখনই তিনি আশ্রয় নিয়েছেন মূল গল্পের!

সুভা : ছায়াহীন এক কায়া

রবীন্দ্রনাথের সব সৃষ্টিই মহাকালের কথা বলে। কালকে অতিক্রম করে পৌঁছে যায় এক সুউচ্চ অনন্যতায়, ‘সুভা’ও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই ভাষাহীন ডাগর চোখের সুভা তার কথা জানান দেয় এক অন্য ভাষায়, যে ভাষা চিরন্তন ও সর্বজনীন। বাঙময় ‘বাচাল মানবকূল’ যা হাজারটা কথায় প্রকাশ করতে সক্ষম নয়, নির্বাক সুভা তার নীরব চোখের ভাষায় তা নিমেষেই প্রকাশ করতে পারে। কারণ, তার ভাষা আর প্রকৃতির ভাষা যে মিলেমিশে একাকার! রবীন্দ্রনাথের সেই ‘সুভা’ অবলম্বনেই চাষী নজরুল সুভা নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্রের শুরুতেই তিনি লিখে দিয়েছেন-‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবিস্মরণীয় ছোট গল্পের ছায়া অবলম্বনে’। আর ‘ছায়া অবলম্বন’ কথাটি আরো দৃঢ়তা দেওয়ার জন্যই হয়তো শুরুতেই জুড়ে দিয়েছেন ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে, ফুল ডোরো বাঁধা ঝুলনা’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি। অথবা এর পিছনে হয়তো রয়েছে ‘প্রথাগত রাবীন্দ্রিক নিয়ম’ বা রাবীন্দ্রিক ঘোর সৃষ্টির প্রয়াস। ছায়া অবলম্বন কথাটিকে কেনো বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

মূল গল্পে বর্ণিত ‘বাণীকণ্ঠের ঘর একেবারে নদীর উপরেই’। এটা মাথায় রেখে চাষী সেই নদী হয়েই বাণীকণ্ঠের বাড়িতে যান। সেটা তিনি যেতেই পারেন। তাতে কারো আপত্তি থাকারও কথা নয়। তবে ঘোর বাধে সুভার শুরুতে জুড়ে দেওয়া ‘ছায়া অবলম্বনে’ কথাটা নিয়ে। ছায়া অবলম্বনে বললেও শুরুর দৃশ্য দিয়ে তিনি মূল গল্পের ডিটেইলকে ধরার যে প্রয়াস চালান, সেটা চলতে থাকে পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে। একে একে তিনি ধরতে চান মূল গল্পের সব চরিত্র ও নানা ঘটনাকে। আবার একই সঙ্গে কেনো জানি চাষী মূল গল্পকে একেবারে পাশ কাটিয়ে ফর্মুলা চলচ্চিত্রের নিয়ম মেনে সামনে নিয়ে আসেন প্রতাপ ও সুভার চমকপ্রদ প্রেম কাহিনি। তবে মূল গল্পকে ধরার চেষ্টা সেখানেও থাকে! মূল গল্পে বর্ণিত ‘এই জন্যে সকলেই সুভাকে সুভা বলিত, প্রতাপ আর-একটু অতিরিক্ত আদর সংযোগ করিয়া সুভাকে ‘সু’ বলিয়া ডাকিত।’ এই ‘সু’ ডাক তিনি সুভাতে প্রতাপের মুখ থেকে ডাকিয়ে নেন, কিন্তু মূল গল্পের প্রেমের মূলভাবটা রাখেন না। ফলে ব্যাপারটা যা দাঁড়ায় তা হলো, তিনি না মূল গল্প ধরে হাঁটেন, না বিনির্মাণ করেন! তবে গল্প নিয়ে যাই করুন না কেনো, ফর্মুলাটা ঠিকই মাথায় রাখেন!

ক. মানুষ নয়, নারী-সুভা প্রসঙ্গ

রবীন্দ্রনাথের সুভা অভিমানী, তবে ‘প্রতিবাদী’ নয়। ‘প্রতিবাদ’ করলেও তার ঝঙ্কার হৃদয় গহন থেকে বাইরে আছড়ে পড়ে না। চাষী সাহস দেখিয়ে সুভাকে ‘প্রতিবাদী’ রূপে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত শেষরক্ষা হয়নি! সুভা আটকে গেছে সেই গৎবাঁধা অধস্তন নারী-ফ্রেমে। তাই সুভার প্রতিবাদ সামগ্রিক না হয়ে ঠেকেছে কেবল নারীর বিরুদ্ধে! বিপরীতে পুরুষের বেলায় সে কোমলমতি; বশ মানা ‘লক্ষ্মী বাঘিনী’। সমবয়সী মেয়েরা সুভাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে তার পা ভেঙে যায়; কিছুদিন পর পা সেরে ওঠে। এরপর সেই মেয়েদের ওপর চড়াও হয় সুভা। এ সময় সেখানে ফর্মুলা চলচ্চিত্রের ‘মহামানব’ নায়কের মতো হাজির হয় প্রতাপ। সে সুভাকে শান্ত করতে করতে বলে, ‘সুভা, এতো রাগ ভালো না, তুই একটা মেয়ে। তোর বিয়ে হবে, একদিন তুই বউ হবি। এ রকম করলে কেউ তোকে বিয়ে করবে না।’ প্রতাপের এসব কথা শুনেই শান্ত হয় ক্ষিপ্ত সুভা! এ ঘটনার মধ্য দিয়েই চাষীর সুভা যে ছকে বাঁধা নারীদেরই একজন, তা স্পষ্ট  হয়ে ওঠে।  আর এর সঙ্গে প্রমাণ হয়, ক্ষিপ্ত নারীকে বশ মানাতে পারে একমাত্র পুরুষই!

চাষীর নারী মানেই প্রেম, কাম ও কোমলতার আধার? নারীকে সবকিছু মেনে নিতে হয়? মানিয়ে নেওয়াটাই নারীর প্রথম কাজ? বিয়েটাই নারীর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য? নারীদের নিজেদের মধ্যকার সমস্যা সমাধানের যোগ্যতাও নারীর নেই, সেজন্যও পুরুষের দরকার? অবাক করা বিষয় হলো, এ কথাগুলো মূল গল্পের কোথাও নেই। এখানে হয়তো চাষী নির্মাতার স্বাধীনতাটুকু কাজে লাগিয়েছেন, তবে পিছিয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথের চেয়েও কয়েকশো বছর। রবীন্দ্রনাথও নারীকে অধস্তন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন; তবে সেটা তখনকার বাস্তবতায়। কিন্তু চাষীর নারী কি তখনকার নারী? চাষী তো ‘ছায়া অবলম্বন’ বলে শুরুতেই দায় এড়িয়েছেন। তবে নারীকে কেনো পিছন থেকে আরো পিছনে নিয়ে গেলেন?

চাষী কেনো জানি নারীকে পুরুষের অধস্তন করে ক্ষান্ত হলেন না, পুরুষের দায়টাও প্রত্যক্ষভাবেই চাপিয়ে দিলেন নারীর কাঁধে। রবীন্দ্রনাথ বহুদিন আগে যে দায় চাপিয়ে ছিলেন পুরুষের কাঁধে, চাষী সে দায়ভার চাপিয়ে দিলেন নারীর ওপর! দায়ী পুরুষকে সাধু করে তুললেন আর নারীকে দাঁড় করালেন নারীর শত্রু ও মিথ্যেবাদীরূপে। মূল গল্পে বাণীকণ্ঠ যেখানে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভারমুক্তি ও একঘরে হওয়ার ভয়ে মেয়ের সম্বন্ধ আনতে কলকাতায় যায়। সেখানে চাষীর সুভাতে সম্বন্ধ আনে সুভার বড়ো বোন সুকেশীনি। সেখানেই শেষ নয়, বাণীকণ্ঠ এ সম্বন্ধের বিরোধিতাও করে। কারণ প্রথমত, এ বিয়েতে সুভার মত নেই। দ্বিতীয়ত, সুভা যে বোবা, এটা বরপক্ষের অগোচরে রাখা হয়।

বিরোধিতা করেও ক্ষান্ত হয় না পুরুষ বাণীকণ্ঠ; সে এ মিথ্যাচারের প্রতিবাদও করতে চায় এবং সুভার পছন্দের পাত্রের সঙ্গেই তার বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সুভার মা ও বোনেরা। মানে, পুরুষ ন্যায়পরায়ণ ও সত্যবাদী আর নারী প্রতারক। তবে চাষী বাণীকণ্ঠকে কেনো সাধু ও প্রতিবাদী করে তুললেন তা চলচ্চিত্রের শেষে আর বুঝতে বাকি থাকে না। সুভার মা-বোন মিলে যে মিথ্যাচার করেছিলো, তার শাস্তি নেমে আসে সুভার ওপর; সুভাকে রেখে তার স্বামী আবার ‘ভাষাবিশিষ্ট’ স্ত্রী আনে। তার মানে নারীর অনিষ্ট নারীরাই করে, পুরুষেরাই একমাত্র নারীর শুভাকাক্সক্ষী!

খ. ভাষাহীন সুভার ভাষা প্রতাপের মুখে

আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের সুভা ভাষাহীন, তবে মনের ভাব প্রকাশে অসমর্থ নয়। আর পাঁচটি মনুষ্য সন্তানের মতো তার মৌখিক বাচালতার সামর্থ্য না থাকলেও, আছে ডাগর চোখের এক বিশাল ভাবের দরিয়া। যে চোখে আয়নার মতো ভেসে ওঠে তার মনের ভাব, আছে প্রকৃতির বিজন মহত্ত্ব। যে চোখের বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

কথায় আমরা যে ভাব প্রকাশ করি সেটা আমাদিগকে অনেকটা নিজের চেষ্টায় গড়িয়া লইতে হয়, কতকটা তর্জমা করার মতো; সকল সময় ঠিক হয় না, ক্ষমতার অভাবে অনেক সময় ভুলও হয়। কিন্তু কালো চোখকে কিছু তর্জমা করিতে হয় না¾মন আপনি তাহার উপর ছায়া ফেলে; ভাব আপনি তাহার উপরে কখনো প্রসারিত কখনো মুদিত হয়; ... কখনো দ্রুত চঞ্চল বিদ্যুতের মতো দিগ্বিদিক ঠিকরিয়া উঠে।

কিন্তু চাষীতে এসে সুভার চোখের সে ভাষা কেনো জানি অনন্যতা হারায়। নীরবতার যে ভাষা আছে তা ঢেকে যায় প্রতাপের বাচালতার মেঘে! চাষী ইচ্ছেমতো ফর্মুলা চলচ্চিত্রের ফর্মুলা মেনে প্রতাপের মুখে জুড়ে দেন ‘সস্তা-জনপ্রিয়’ সব প্রেমের সংলাপ; ভাষাহীন সুভার কথাও বলিয়ে নেন প্রতাপের মুখ দিয়ে। যেমন রবীন্দ্রনাথ সুভার মনের ইচ্ছাকে ফুটিয়ে তুলতে বলেছিলেন, ‘সুভা যদি জলকুমারী হইত’ কিংবা ‘আমাদের সু সেই মনিদীপ্ত গভীর নিস্তব্ধ পাতালপুরীর একমাত্র রাজকন্যা।’ আর চাষী এ কথাগুলো একটু কৌশলে প্রতাপের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলেন এভাবে-‘আমি রাজা, তুই রানি’। সুভার মনের কথা কেনো প্রতাপের মুখ থেকেই বের করতে হবে? সুভার কথা যদি প্রতাপই বলে দেয়, তবে সুভার ওই ডাগর চোখের মহত্ত্ব থাকলো কোথায়? নাকি ধরি মাছ, না ছুঁই পানি? মানে রবীন্দ্রনাথকে ঠিক রাখলেন, আবার ফর্মুলাও রক্ষা করলেন। নাকি নৈশব্দের ভাষাকে এড়িয়ে গেলেন স্বেচ্ছায়? গল্পে বর্ণিত ‘এই বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির একটা বিজন মহত্ত্ব আছে’, তা ম্রিয়মাণ হয়ে গেলো প্রতাপের বাচালতার তোড়ে।

গ. যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

রবীন্দ্রনাথ যেখানে বলেছেন, ‘উন্নত শ্রেণীর জীবের মধ্যে সুভার আরো একটি সঙ্গী জুটিয়াছিলো। কিন্তু তাহার সহিত বালিকার ঠিক কিরূপ সম্পর্ক ছিলো তাহা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ, সে ভাষাবিশিষ্ট জীব; সুতরাং উভয়ের মধ্যে সমভাষা ছিলো না।’ মূল গল্পের সেই অনির্ণীয় সম্পর্কই চলচ্চিত্রে ধরা দেয় বড়ো হয়ে। যে একপাক্ষিক প্রেমের উপাখ্যান শেষমেষ মূল গল্পে পাওয়া যায়, তা দ্বিপাক্ষিক হয়ে বৃহৎ আকার লাভ করে। প্রতাপ সুভার প্রেমে ‘হাবুডুবু’ খায়, বউ করে ঘরে আনার স্বপ্ন দেখে। শুধু স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হয় না সে, বাবা-মায়ের মত না নিয়েই সুভার বাড়িতে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়।

একপর্যায়ে ফর্মুলা চলচ্চিত্রের নিয়ম মেনেই সুভার বাবা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন প্রতাপের বাবার কাছে। প্রতাপের বাবা সে প্রস্তাব সদর্পে প্রত্যাখ্যান করেন। শুরু হয় বিরহের পালা। এবার প্রেমিক ও ‘অবাধ্য’ প্রতাপ সুবোধ বালকে পরিণত হয়! মানে ফর্মুলা চলচ্চিত্রের ফর্মুলা মেনেই বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়; আর তার প্রেমে শেষ পর্যন্ত বলি হয় সুভা। এখন কিছু প্রশ্ন সামনে চলে আসে। চাষী ‘ছায়া অবলম্বন’ বা ‘নির্মাতার স্বাধীনতা’কে কাজে লাগিয়ে মূল গল্পের অনির্ণীয়, একপাক্ষিক ও অপ্রকাশিত প্রেমকে দ্বিপাক্ষিক করতে পারলেন। কিন্তু সে প্রেমের পরিণতিকে কেনো আবার মূল গল্পের সঙ্গে মেলালেন? তবে কি তিনি দুই নৌকায় পা রাখার চেষ্টা করলেন? যাতে এক নৌকা ডুবলেও আরেক নৌকায় আশ্রয় নিতে পারেন? মানে একদিকে ফর্মুলা দিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা, অন্যদিকে রাবীন্দ্রিক ইমেজ কাজে লাগানো।

ঘ. এ প্রয়োজন কি কাহিনির?

রবীন্দ্রনাথ যে প্রতাপকে অকর্মণ্য বলে পরিচয় দিলেন, সে প্রতাপকে চাষীও অকর্মণ্যই রাখলেন। তবে সব বিষয়ে উদাসীন প্রতাপকে কেনো জানি প্রেমের বেলায় করলেন বেশ সচেতন। আর তার এই প্রেম-সচেতনতা থেকেই শুরু হলো পারিবারিক মেলোড্রামা, দুই পরিবারের অনিবার্য সংঘাত; খলনায়কের ভূমিকায় আবির্ভূত হলেন প্রতাপের বাবা। আর মহা প্রতাপে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়ালেন সুভা-প্রতাপের প্রেমেও। যার পরিণতি ঠেকলো গিয়ে সেই ফর্মুলায়; বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো প্রেমিক যুগল। অবশেষে এক ফর্মুলা ট্রাজেডি!

রবীন্দ্রনাথের উদাসীন-অকর্মণ্য প্রতাপকে সব বিষয় বাদ দিয়ে ত্যাগী ও সচেতন ফর্মুলা-প্রেমিক বানানোর উদ্দেশ্যটা কী? সে উত্তরটাও হয়তো এতক্ষণে দর্শকের জানা। কারণ চাষী সুভায় যে প্রেম দেখিয়েছেন, প্রতাপ প্রেম-সচেতন না হলে তা হয়তো দেখানো সম্ভব ছিলো না। কারণ মূল গল্পে এই প্রেম তো অস্তিত্বহীন প্রায়।

ঙ. সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না!

চলচ্চিত্রের শুরুতে ‘ছায়া অবলম্বনে’ জুড়ে দেওয়া চাষী দৃশ্যায়ন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সংলাপসহ নির্মাণের সব ক্ষেত্রে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। নিজের মতো নির্মাণ, মূল গল্পকে ধরতে চাওয়া, আবার কখনো মূল গল্পের কথাকে প্রায় অবিকৃতভাবে কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেওয়া-সুভায় যেনো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘সুভা’য় এভাবে বলেছেন, ‘বাণীকণ্ঠের সচ্ছল অবস্থা, দুই বেলাই মাছভাত খায়, এজন্য তাহার শত্রু ছিলো।’ চাষী সে কথা সুভায় বাণীকণ্ঠের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলেন এভাবে,¾ওসব শত্রুর কর্ম, আমার অবস্থা সচ্ছল, দুবেলাই মাছ-ভাত খাই।’

আবার মূল গল্পের ‘বোবা মেয়েকে পরের হস্তে সমর্পণ করিয়া বাপ-মা দেশে চলিয়া গেল-তাহাদের জাতি ও পরকাল রক্ষা হইল।’ এ কথাগুলো সুভার মায়ের মুখ থেকে বলালেন এমন করে, ‘বাবা-মা হিসেবে আমাদের দায় শেষ। ভগবানের কাছে পরকাল রক্ষা হলো।’ এভাবেই চলতে থাকে পুরো চলচ্চিত্র জুড়ে। তিনি সুভার সমাপ্তি টানতেও চলে যান মূল গল্পের কাছে। মূল গল্পের ‘এবার তাহার স্বামী চক্ষু এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা পরীক্ষা করিয়া এক ভাষাবিশিষ্ট কন্যা বিবাহ করিয়া আনিল’-এ কথাগুলোও তিনি সুভায় বলিয়ে নেন এভাবে-‘আমি এক্ষুণি কলিকাতা যাচ্ছি। দুদিন পর বউ নিয়ে ফিরবো, ভাষাবিশিষ্ট বউ। তোর মতো বোবা-কালা নয়। চক্ষু-কর্ণ-ইন্দ্রিয় দ্বারা পরীক্ষা করে বউ আনবো, নতুন বউ।’

শেষ পর্যন্ত বিষয়টা এমন দাঁড়ালো যে, চাষী নিজের মতো করে নির্মাণ করতে গিয়ে যখন কোথাও আটকে যাচ্ছেন তখনই আশ্রয় নিচ্ছেন রবীন্দ্র ছায়াতলে। তাই তিনি যে কথাগুলো না বলেও দৃশ্যায়ন ও ডিটেইল ব্যবহার করে দর্শককে বোঝাতে পারতেন, তা কথার দ্বারা বোঝাতে গিয়ে প্রত্যেক চরিত্রকে বাচাল করে তুললেন। এমনকি বোবা সুভার নাটকীয় অঙ্গভঙ্গির ফলে তার ‘অনন্যতাও’ অনেকাংশে হ্রাস পেলো। এরপর সংলাপে সেই প্রচলিত বাংলা চলচ্চিত্রের যাত্রার ঢঙ তো থাকছেই।

প্রথাবদ্ধ রাবীন্দ্রিক ঘোর

চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার নতুন নয়। নির্মাতা রবীন্দ্রসঙ্গীত কেনো, কাহিনির প্রয়োজনে যেকোনো গানই চলচ্চিত্রে ব্যবহার করতে পারেন। বিশ্বচলচ্চিত্রে সঙ্গীতের ব্যবহার প্রায় সবাক চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সমান্তরাল। আর উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে তো গান অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে কাহিনিকে ছাপিয়ে যদি গানই মুখ্য হয়ে ওঠে, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ আছে বৈকি। এবার আসছি মূল প্রসঙ্গে, চাষী শাস্তির টাইটেল কার্ডের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি; হয়তো তাতে কারো আপত্তি থাকার কথাও নয়। তিনি ‘প্রথাবদ্ধ রাবীন্দ্রিক নিয়ম’ মেনে এটা করতেই পারেন। মানে রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে নির্মিত চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারের যে প্রথা, সেটা অনুসরণ করতেই পারেন।

তবে বিপত্তিটা বাধে অন্যখানে। আগেই বলেছিলাম ফর্মুলার কথা। যার প্রয়োজনে চাষীকে প্রথমেই প্রেম টেনে আনতে হয়। এবার সে প্রেমকে রঙচঙ মেখে উপস্থাপনের জন্য দরকার পড়ে গানের। ফর্মুলা মেনে কথায় কথায় নিয়মিত বিরতি দিয়ে গান শোনান। শাস্তির ১৭ মিনিট ছয় সেকেন্ডে শুরু হয় ‘তুই ছাড়া আমার চোখে পিত্তিমি নেই’ গানটি। আর গানটি এমন সময় পর্দায় হাজির হয়, যখন নায়ক-নায়িকার প্রেম সবেমাত্র জমতে শুরু করেছে। এর মাত্র পাঁচ মিনিট পর ২২ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে যখন কাউকে না জানিয়ে ছিদাম-চন্দরা মালা বদল করে, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে আবারো জুড়ে দেওয়া হয় ‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে’। এতক্ষণে বোঝা গেলো ‘অনুপম চলচ্চিত্রের’ বৈশিষ্ট্য, মূল গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যে প্রেম চাষী শাস্তিতে জোর করে টেনে আনলেন, তাকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই তবে এই আয়োজন। আর এই আয়োজন করবেন বলেই হয়তো টাইটেল কার্ডের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত জুড়ে দিয়ে রাবীন্দ্রিক ঘোর তৈরি করে নিয়েছিলেন! যে ঘোর রবীন্দ্রনাথের নামে করা অরাবীন্দ্রিক কর্মকেও অনায়াসে বৈধ করে তোলে! অনেকটা ‘অন্ধ ধার্মিক’কে ধর্মের নাম করে কেঁচো খাওয়ানোর মতো।

প্রেম, মালাবদল তো গেলো, চন্দরার বাবার মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে ৩৫ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজলো ‘জানি, জানি, জানি, জানি গো দিন যাবে’। শোকের পর ফর্মুলা চলচ্চিত্রের ফর্মুলা ধরতে চাষীর প্রয়োজন পড়লো ‘আইটেম সঙের’। ৪৭ মিনিট ৩০ সেকেন্ডে তিনি হাজির হলেন তা নিয়ে, এবার অবশ্য রবীন্দ্রনাথের নামগন্ধ নেই-‘সিঙ কেটে ঢুইকেছে চোর’। প্রেম-শোক-আইটেম, এবার আবার শোক। চন্দরার ফাঁসি, বিদায়ের সঙ্গে থাকছে ছিদাম-চন্দরার বিরহের পালা, সেখানেও গানের দরকার। তাই চন্দরার ফাঁসির দৃশ্যের সঙ্গে দুই ঘণ্টা ১২ সেকেন্ডে চাষী জুড়ে দিলেন সেই ‘গতানুগতিক’ রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আমার যাবার বেলায়’। আর সবশেষে দর্শককে একটু নস্টালজিক না করলেই নয়। তাই শেষের টাইটেল কার্ডের সঙ্গে আবারও জুড়ে দিলেন ‘তুই ছাড়া আমার চোখে পিত্তিমি নেই’। যে গানের মধ্য দিয়েই ছিদাম-চন্দরার প্রেমের সূচনা হয়েছিলো।

শাস্তির মতো টাইটেল কার্ডের সঙ্গে ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে’ রবীন্দ্রসঙ্গীত জুড়ে দিয়ে সুভাতেও সঙ্গীতের যে জয়জয়কার শুরু হলো তা চলতে থাকলো পুরোটা সময় ধরে। এখানেও চাষী ফর্মুলার প্রয়োজনে এনেছেন প্রেম আর প্রেমের প্রয়োজনে গান। টাইটেল কার্ডের পর সুভা-প্রতাপের প্রেমের সূচনালগ্নে সুভার ১০ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে জুড়ে দিলেন ‘চাঁদের আলোতে বাঁধ ভেঙে যাবে’। প্রেমের পর রোমান্স, তাই একটু বিরতি দিয়ে ৩৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে সুভা-প্রতাপকে পর্দায় রেখে শোনানো হলো ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’। প্রেম-রোমান্সের পর এখন দরকার বিরহ, তাই বিরহী প্রতাপের দুর্দশা ও হতাশাগ্রস্ত ভাব দেখাতে সুভার এক ঘণ্টা ২৫ মিনিট দুই সেকেন্ডে এলো ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’।

প্রতাপের দুঃখ এবার সুভার কাছে দুর্দশা হয়ে পৌঁছায়; সুভার স্বামী তাকে রেখে যখন দ্বিতীয় বিয়ে করতে যায়। সুভার সে দুর্দশায় গান ছাড়া চলে না, তাই এবার ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে’। তাহলে যেটা দাঁড়ালো¾প্রেম-রোমান্স, তারপর দুই পক্ষের বিরহ। রবীন্দ্রনাথ স্বমহিমায় যে সৃষ্টিকে অমর করলেন, চাষী ‘নিজগুণে’ ফর্মুলা রক্ষা করতে গিয়ে তাকে ‘বিকলাঙ্গ’ করলেন!

ইহাকে শেষ না বলিয়া উপায় নাই

আগেই বলেছিলাম সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র-নির্মাণ খুব কঠিন কাজ, বিশেষ করে রবীন্দ্রসাহিত্য থেকে তো বটেই। চাষী সে কঠিন কাজ করার সাহস দেখিয়েছেন। তবে তিনি দু-নৌকায় পা দিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত জলে পড়ে গেলেন; নিজেও ভিজলেন, রবীন্দ্রনাথকেও ভেজালেন! শাস্তির শুরুতে বলা ‘অনুপম চিত্রায়ণ’ যেমন তার অনুপমতা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেনি, তেমনি ছায়া অবলম্বনে বলে শুরু করা সুভাও আর রবীন্দ্রনাথের ‘ছায়া’র মধ্যে থাকেনি। চাষী না মূল গল্পের হুবহু চিত্রায়ণ করেছেন, না বিনির্মাণ করেছেন। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে ফর্মুলায় চোখ রেখেছেন ঠিকই। এই বিনির্মাণ ফর্মুলার প্রয়োজনে। ফলে শেষ পর্যন্ত যা হয়েছে তা খিচুড়ি! মানে নির্মাতার স্বাধীনতা ও মূল গল্পকে ধরার প্রয়াস তালগোল পাকিয়ে হয়েছে হাইব্রিড রাবীন্দ্রিক মেলোড্রামা।

লেখক : নাজমুল রানা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

ranamcj.ru@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব (২০১১ : ৩১); কীভাবে ছবি করি কীভাবে ছবি হয়; পরম্পরা প্রকাশন, কলকাতা।

২. প্রাগুক্ত; দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব (২০১১ : ১১০-১১১)।

৩. প্রাগুক্ত; দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব (২০১১ : ৯)।

৪. প্রাগুক্ত; দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব (২০১১ : ৯৫-৯৬)।

৫. হুক, লোটে; ‘ছয়টা গান + দশটা মারপিট + একটা প্রেম = বাংলা ছবি?’; প্রথম আলো, ২৭ আগস্ট ২০০৯।




বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।




এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন